১৯৭১ ও ২০২৪: ইতিহাসের ধারাবাহিকতা

পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে একাত্তরের এই দিনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের বুকে ছিল মৃত্যুকে উপেক্ষা করার সাহস, অন্তরে মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে বারবার পরাহত হয়েছে সেই স্বপ্ন। খোলা চোখে মুক্তিযুদ্ধের অবলোকন নিয়ে এই লেখা।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যুদ্ধের অবকাশে ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১ছবি: আনোয়ার হোসেন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে সত্যি সত্যিই আমাদের পূর্বপ্রজন্ম প্রমাণ করেছিল, নিঃশেষে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকা যায়। এ কারণে অনেক ইতিহাসবিদ যথার্থই ১৯৭১ সালকে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

তবে খেয়াল রাখা দরকার, ১৯৭১ সাল ছিল এই জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিক মুক্তির সংগ্রামের এক অধ্যায়। ১৯৭১ সালে আমাদের ইতিহাস শুরু হয়নি, শেষও হয়নি। ১৯৪৭ সালের পার্টিশন তথা পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধেও নানাভাবে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন—এমন অনেকেই স্বীকার করেছেন দুটিই ছিল ‘সময়ের প্রয়োজনে’। কেউ কেউ বলেছেন, ‘ইতিহাসের প্রয়োজনে’। অর্থাৎ, তাঁরা ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালকে পরস্পরের বিপরীত হিসেবে দেখতে চাননি।

সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও অভিমুখ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একাত্তরের আবির্ভাব ঘটেছিল। অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য থাকবে না, রাষ্ট্রীয় জুলুম থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একাত্তরের মতো ‘মহাসিন্ধুর কল্লোল’ বেহাত হতে সময় নেয়নি।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, কংগ্রেস–প্রভাবিত বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র ইতিহাসে একাত্তরকে মনে করা হয় সাতচল্লিশের ‘ভ্রম সংশোধন’। বলা বাহুল্য, এ ধারণা ও বয়ান অনৈতিহাসিক। বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডকে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর জায়গা থেকে দেখলে এ জনগোষ্ঠী নিজের অধিকার ও মুক্তির লক্ষ্যে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সাতচল্লিশ ও একাত্তর পরস্পরের পরিপূরক, সাতচল্লিশ না ঘটলে একাত্তরও ঘটত কি না, সে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।

সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও অভিমুখ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একাত্তরের আবির্ভাব ঘটেছিল। অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য থাকবে না, রাষ্ট্রীয় জুলুম থাকবে না; থাকবে না ধর্ম কিংবা ভাষার নামে নিপীড়ন ও বঞ্চনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একাত্তরের মতো ‘মহাসিন্ধুর কল্লোল’ বেহাত হতে সময় নেয়নি। বাহাত্তর সাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ও সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে শুরু করে। স্বাধীনতা থেকে রাষ্ট্রগঠনের অনিবার্য ধাপ সম্পন্ন করার কাজ অধরা থেকে যায়। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলীয় সংবিধান, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দখল, নির্বাচনকে প্রভাবিত করা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সব দলের রাজনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করে একদলীয় শাসন কায়েম করা—এসবই ছিল মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী ‘আদি পাপ’। এ অন্যায়গুলো একটি দলের নেতৃত্বে হলেও এর পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে গোটা জনগোষ্ঠীকে।

এর পরিণামে আমরা দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দুই দশকে রাষ্ট্রগঠন প্রধান এজেন্ডা না হয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, ক্যু পাল্টা–ক্যু, সামরিক শাসন, গণতন্ত্রহীনতা এবং হত্যার রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছিল। এর কোনোটাই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, রাষ্ট্রগঠনের ব্যর্থতা তথা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে স্রেফ নির্বাচন যে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে না, এই সহজ বাস্তবতা উপলব্ধির ঘাটতি লক্ষ করা যায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণরায়ের প্রতিফলন সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, স্রেফ পঞ্চবার্ষিক ভোটাভুটি গণতন্ত্র নিশ্চিত করেনি।

তবু মন্দের ভালো হিসেবে পঞ্চবার্ষিক ভোটাভুটিটুকু অন্তত ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা কয়েকটি বাজে নজির সৃষ্টি করে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের জোরে এমন এক সংশোধনী আনে, যা রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। আইনবিশেষজ্ঞ, সিভিল সোসাইটির সদস্য, অ্যামিকাস কিউরির মতামত অগ্রাহ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে এমন কোনো ধারা ছিল না। অর্থাৎ, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে জনগণের পিঠে ছুরি মারার মতো এক ভয়াবহ নজির আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করেছিল।

এর পরিণতিও ভয়াবহ হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে তিনটি অবৈধ নির্বাচন গায়ের জোরে তারা করেছে। এসব নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। এ তিনটি নির্বাচন যথাক্রমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, রাতের নির্বাচন এবং ডামি নির্বাচনের কুখ্যাতি অর্জন করেছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসন ছিল প্রাণঘাতী শাসন। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, নিবর্তনমূলক আইন, লুটপাট, মেগা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার—এসবই ছিল বিগত শাসনামলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সব জায়গায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। দেশ থেকে রাজনৈতিক পরিসর বিলুপ্ত হয়ে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। অনেক গবেষক তাই এই শাসনামলকে ‘বাকশাল ২’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। জুলাই গণহত্যা ছিল এই মাফিয়া ও প্রাণঘাতী শাসনের শেষ কামড়।

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানকে এই বিস্তৃত পটভূমিতে বুঝতে পারা জরুরি। সরকারি চাকরিতে নিজের মেধার জোরে প্রতিযোগিতা করার ন্যায্য অধিকার থেকে দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ বঞ্চিত হচ্ছিল। বছরের পর বছর ধরে কোটাপ্রথা জারি রেখে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সর্বত্র নিজেদের অনুগত লোকদের ঢুকিয়েছে। ফলে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে স্রেফ ‘চাকরির আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে। এ আন্দোলন ছিল অর্থনৈতিক ও জীবিকার প্রশ্নে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশের তরুণদের বিদ্রোহী পদক্ষেপ। এ কারণেই আন্দোলনের ব্যানার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ দ্রুত বৃহত্তর জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তরুণদের চাকরি পাওয়ার সঙ্গে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান।

জুলাই মাসে আওয়ামী মাফিয়া শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট তরুণ সম্প্রদায় এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা একবিন্দুতে এসে মিলেছিল। ফলে ছাত্র-জনতার বহুল প্রত্যাশিত এক ঐতিহাসিক মৈত্রী ঘটেছিল। গত ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম এক দফা ঘোষণা করে: ফ্যাসিবাদের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে ‘এক দফা’ মানে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের দাবি ও ডাক। এই দফা সাধারণত ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী ব্যক্তিকে নিশানা করে থাকে। ফলে স্বৈরাচারের পতন হয় ঠিকই, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র থেকে যায়।

এই দিক বিচারে ৩ আগস্টের এক দফা ছিল মূলত রাষ্ট্রগঠনের ঐতিহাসিক ডাক। এবারের এক দফাতে ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা ও অপ্রাপ্তি ঘোচানোর ডাক স্পষ্ট। শুধু ফ্যাসিবাদী রেজিম নয়; ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হাসিল করার ঐতিহাসিক দায় বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাঁধে বর্তেছে। এ কারণে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরও ছাত্রসমাজ নতুন রাজনীতি নিয়ে মাঠে হাজির আছে। প্রায়ই রাজপথের স্লোগানে শোনা যাচ্ছে: আবু সাঈদ, মুগ্ধ; শেষ হয়নি যুদ্ধ। এর সরল অর্থ এই যে যদি আসাদ ও নূর হোসেনের শহীদি আত্মদানের সঠিক মূল্যায়ন হতো, তাহলে চব্বিশে এসে আবু সাঈদদের প্রাণ দিতে হতো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা এই যে এখনো বৈষম্যহীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের তরুণদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হচ্ছে।

এখানেই একাত্তর আর চব্বিশের সম্পর্ক তথা ঐতিহাসিক যোগসাজশ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হিসেবেই এ দুই ঐতিহাসিক বিন্দুকে বোঝা দরকার। পূর্বতন সব রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে চব্বিশের যাত্রা শুরু। সাতচল্লিশ, একাত্তর ও নব্বইয়ের অর্জন ও বঞ্চনার চূড়ার বিন্দু হিসেবে হাজির হয়েছে চব্বিশ। উল্লিখিত বিন্দুগুলোর অর্জনকে সংহত করা এবং না-পাওয়াকে হাসিল করার লক্ষ্যে চব্বিশের প্রজন্মের রুহের মিল গঠিত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক মওকা হেলায় হারানো যাবে না।

এ অঞ্চলের প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্বে ছাত্রসমাজ এগিয়ে এসেছে এবং রাজনৈতিক পরিণতির অভিমুখ নির্ধারণ করেছে। বৃহত্তর জনগণ ছাত্রশক্তির ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং গণ–অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পদাঙ্ক অনুসরণে বাধ্য হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ইতিহাসের অন্যান্য পর্বের সঙ্গে ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের তাৎপর্যপূর্ণ ফারাকও নজর এড়ায় না। অতীতে অভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র-জনতার আত্মদান ও বিসর্জনের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তাদের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। ক্ষমতায় গিয়ে দলগুলো ঔপনিবেশিক প্রভুতে পরিণত হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়ী ছাত্রশক্তি এ ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন। তাই আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিজয়ী ছাত্রশক্তি আবারও মাঠে নেমেছে। এবার তারা রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন করতে চায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর কোনো অতীত নজির নেই।

ছাত্র-জনতার চব্বিশ এসেছে একাত্তরকে সুসংহত করতে। চব্বিশের কাঁধে আওয়ামী লীগের চেতনা–ব্যবসার করাল থাবা থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ‘মুক্ত’ করার ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব। ছাত্র-জনতার সফলতা-ব্যর্থতার ওপর রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

  • সারোয়ার তুষার: লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি