জীবন আর মৃত্যু প্রায় একই বিষয়। আমি এক মিনিট বাঁচলাম মানে জীবন থেকে এক মিনিট শেষ হয়ে গেল। আমাদের জীবনের অগ্রযাত্রাও তেমনি। এ মানবজাতির স্বপ্ন যেমন, তেমনি আবার মানবজাতির দুঃখও বটে। আমরা পাই হারানোর মধ্য দিয়েই। তাই হয়তো কবি বলেছেন, ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ।’ এবার আমাদের নতুন বছরটি এসেছে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে, অনেক আশা জাগিয়ে। আবার পাতায় পাতায় হয়তো অনেক শিশির জমবে, বেদনায় মথিত হবে আকাশ, জাগবে অনেক আনন্দধ্বনি। তার মধ্য দিয়েই পৃথিবী এগোবে। এগোবে, কিন্তু এগোবে আগের চেয়ে কিছুটা উচ্চ স্তরে। হাঁটলে কষ্ট আছে, কিন্তু এর মধ্যে আবার একটা অতিক্রমণও আছে। হাঁটলে কেউ পেছনে যায় না। আমরা গত বছর যতটুকু এগিয়েছি, সামনের বছরও আরেকটু বেশি এগোব, দুঃখ আর বেদনার মধ্য দিয়ে উচ্চায়ত পৃথিবীর কাছে যাব—এই তো আমাদের স্বপ্ন।
এই মুহূর্তে আমরা আছি এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনার সামনে। ২০২৪-এর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সামান্যকে দিয়ে, কিন্তু শেষ হয়েছিল সর্বজনীনতায়। বাস্তবের সেই বিভক্তির অভিঘাত বর্তমান সরকারকে হয়তো কিছু পরিমাণে বহন করতে হচ্ছে। সে সরকার হয়েছে, আবার হয়ওনি। অন্তত একটি শক্তিমান সরকারের পরিপূর্ণরূপে সে বিকশিত হতে পারেনি। কয়েক দিন আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন ছাত্রনেতা বলেছেন, এ সরকার অন্তর্বর্তীকালীনও নয়, বিপ্লবীও নয়। কথাটা খুব একটা অমূলক নয়। তবু যে এই সরকার এতখানি ভারসাম্য ও শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কারণ জনসমর্থন। এই অবিমিশ্র জনসমর্থনকে আমি গণতান্ত্রিক স্বপ্নের উজ্জ্বলতম রূপ বলে মনে করি। যে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে এই জাতি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা যাবতীয় বিপর্যয়ের মুখে অবিচল হয়ে আজ অপেক্ষা করেছে, তা আমাদের মানসিক পরিণতিরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। উচ্চতর কিছুকে পাওয়ার জন্য আমাদের হয়তো আরও কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। একটা জাতির জীবনের জন্য তা আর কদিনই–বা। সেই ফারসি প্রবাদ আমরা যেন না ভুলি: ‘দের আয়াদ দুরস্ত আয়াদ’—দেরিতে এলে ভালো কিছুই আসে।
আমরা অনেক কিছুই হারিয়েছি, কিন্তু গণজাগরণের সময় যে শক্তি সারা জাতিকে ছাপিয়ে উঠেছিল, তা এখনো সক্রিয়। অনেকে ভয় পেয়ে মনে করেন আমরা আবার পশ্চাৎপদতার দিকে চলে যাব কি না। কিন্তু এই শঙ্কার কারণ নেই। কোনো অন্ধকার শক্তির হাতে বাংলাদেশের নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার কথা নয়। আমরা একটি সচেতন ও অগ্রসর জাতি। গত দুই শ বছরে ইউরোপীয় জাতিগুলোর বাইরে বাঙালিরাই হয়তো একমাত্র জাতি, যা রেনেসাঁসের আলোয় দীপিত হয়েছিল। আমরা ঐহিক, যৌক্তিক, সৃজনশীল ও মানববাদী।
এ ছাড়া বাঙালির রয়েছে একটা বিশেষ ধরনের উদারতা, স্বাধীনতার যুগযুগান্তরের স্পৃহা ও উচ্চতর জীবনের অন্বেষা। পূর্ব বাংলায় বৌদ্ধ সহজিয়া ও ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব বাংলাদেশকে এমন এক উদারতার দীক্ষা দিয়েছে, যা পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে। এই যে জুলাই-আগস্টে যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল, তা কিন্তু আমাদের সৃজনশীল মানসিকতারই ফসল। ক্ষান্তিহীনভাবে বাঙালিরা নতুন ধারণার জনক। ব্রিটিশ আমলে গোখলে বলেছিলেন, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, রেস্ট অব ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো।’ গত জুলাই ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের কাছ থেকেও আমরা একটা নতুন ধারণা উপহার পেয়েছি। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো সবাই আজ পর্যন্ত ব্রিটিশদের প্রণীত মান্ধাতা আমলের আইনকানুন, সংবিধান, প্রথা–পদ্ধতি—এগুলোর বোঝা টেনে টেনেই এগিয়ে চলেছে। এই প্রথম বাংলাদেশ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। বলল, আমরা ওই জীর্ণ পরিত্যক্ত রাষ্ট্রনীতির সংস্কার চাই, এ জাতির প্রকৃতির অনুকূল শাসনব্যবস্থা চাই। নিজেদের ভাগ্য আমরা নিজেরা গড়ব।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র কিন্তু জনগণের চেয়ে সব সময়ই কিছুটা পশ্চাৎপদ জিনিস। জনগণ সৃজনের উল্লাসে এগিয়ে যায়, রাষ্ট্র পিছিয়ে থাকে। এ জন্য আমাদের সবার মধে৵ সব সময় রাষ্ট্রকে নিয়ে এত সমালোচনা, এত অভিযোগ। তাই রাষ্ট্রের নীতি–পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করে তোলার এত চেষ্টা। কিন্তু রাষ্ট্রের বিশালতা আর ধীরগতির কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিপ্লবগুলো প্রচণ্ড অভিঘাতে রাষ্ট্র আর মানুষকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় একই ও অভিন্ন সমতলে। এই সমতাপ্রক্রিয়া কখনো শেষ হয় না। আবার জনগণ এগিয়ে যায়, রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ে, আবার বিপ্লব হয়। এভাবেই রাষ্ট্র দেশ এগিয়ে চলে।
২০২৪–এ আমরা বলছি, আমাদের ন্যায়সম্মত রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই, ওই জীর্ণ পরিত্যক্ত ব্যবস্থা দিয়ে আমাদের চলছে না। কাজেই এবার আমাদের সংগ্রাম রাষ্ট্র আর ন্যায়কে একই পাটাতনে নিয়ে আসার। অনেক গুণ থাকলেও আমাদের মধে৵ একটা পরস্পরবিরোধী ব্যাপার আছে। আমরা যেমন সৃজনশীল, তেমনি অধৈয৴। এ ব্যাপারে আমাদের স্বভাব অনেকটা ফরাসিদের মতো। ফ্রান্স যেমন সৃজনশীল, তেমনি অস্থির। যখন দ্য গলকে ফ্রান্সের সংবিধান রচনা করতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যে জাতি ২৬৪ রকম পনির বানাতে পারে, সে জাতির শাসনতন্ত্র তৈরি করা সতি৵ই কঠিন।’ আমাদের মধে৵ বড় তাড়াহুড়া। তবু অভ্যুত্থান–উত্তর যুগে আমরা অনেক ধৈর্য ও পরিণতির পরিচয় দিয়েছি। আশা করি, এ পরিচয় আমরা ভবিষ৵তেও দেব। কোনো সৎ চেষ্টাই ব্যর্থ না। তাতে স্বর্গ অজি৴ত না হলেও নরকের হাত থেকে আমরা অনেকটাই বাঁচতে পারি।
আমরা যেন না ভুলি সংস্কারের ব্যাপারে কোনো ব্যর্থতা আর একবার জাতির রক্তক্ষরণকে অহেতুক অনিবার্য করে তুলতে পারে।
২০২৪–এ তরুণেরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, ২০২৫ তারচেয়েও উজ্জ্বল আলোকিত দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমাদের দুয়ারে হাজির হয়েছে।