ঢাবিতে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, দরকার নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার: বিজ্ঞান শিক্ষার্থী-শিক্ষকের ভাবনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। আজ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায়ছবি: প্রথম আলো।

পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির উত্তরণ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনে এমন ভূমিকা রাখতে পারেনি, যেমনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) রেখেছে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তাই এখানে শিক্ষা ও গবেষণায় জোর দিতে হবে। এ জন্য অর্থ ও অবকাঠামোসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন করতে হবে।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার: বিজ্ঞান শিক্ষার্থী-শিক্ষকের ভাবনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ কথা উঠে আসে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ’ এর উদ্যোগে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ। তিনি একাডেমিক স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের আদেশ (এই আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়) সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক মুস্তাক ইবনে আয়ুব এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাদরা তাবাসসুম। উপস্থাপনার পাশাপাশি তাঁদের মূল প্রবন্ধটি উপস্থিত সাংবাদিকসহ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল ও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরে লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়, অনেকের কাছেই এই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। তর্কসাপেক্ষে বলা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী এই পরিচয় নিয়েই এগিয়ে যাবে, নাকি একটি বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়-জ্ঞানচর্চা এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ, এই বিষয়গুলোর উৎকর্ষ অর্জনে মনোনিবেশ করবে?

প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করে সেসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এই বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অনুষদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সোসাইটি, সায়েন্স সোসাইটি ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশ ও পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রবন্ধে বলা হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে আগ্রহী। কেবল প্রায়োগিক গবেষণা নয়, মৌলিক গবেষণা উৎসাহিত করার উদ্যোগ এবং বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। শিক্ষক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের মতামতের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ রকম আরও বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধানের কথা তুলে ধরা হয়।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি ও আধিপত্য বিস্তারকারী আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্রের চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ে এ রকম রাজনৈতিক কার্যক্রম সংস্কার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ছাড়া শিক্ষার্থীদের অন্য সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রস্তাব করছেন। এ ছাড়া শিক্ষক সমিতি, সিনেট, সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পর্যায়ে শিক্ষকদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি প্যানেল নিষিদ্ধ করতে হবে।

সভা প্রধানের বক্তব্যে অধ্যাপক সংগীতা আহমেদ মতবিনিময় সভায় উঠে আসা আলোচনার সারমর্ম তুলে ধরেন। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে নিজেদের সংস্কার করতে হবে, তারপর শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ। কাজেই সংস্কার শুরু করতে হবে নিজের ভেতর থেকেই।

সঞ্চালকের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকদের মুঠোফোন আনা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন।

কার্জন হল এলাকায় খাবারের ব্যবস্থা না থাকার (আবাসিক হল ছাড়া) সমস্যার কথা তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র এবং প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী উমামা ফাতেমা। এ জন্য কার্জন হল এলাকার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো ক্যানটিনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দেন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আহাদ বিন ইসলাম।

বেলা পৌনে তিনটায় শুরু হওয়া এই মতবিনিময় সভা চলে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত। এতে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক উপমা কবির, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সুমাইয়া মামুন প্রমুখ। এ ছাড়াও মুক্ত আলোচনায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।