সন্দ্বীপে ‘ধাবানি’ পশুপালনে আগ্রহ বাড়ছে, যাচ্ছে কোরবানির হাটেও
সন্দ্বীপে ধাবানি–পদ্ধতিতে পালিত ২৫ হাজার গরু, মহিষ, ভেড়া চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর কোরবানির হাটে নেওয়া হচ্ছে।
আবছা অন্ধকারে সাগরপারের চরে কয়েক হাজার গরু, মহিষ আর ভেড়া চরে বেড়াতে দেখা গেল। বেশ আগেই সন্ধ্যা নেমেছে; কিন্তু এসব গবাদিপশুকে ঘরে ফেরানো হয়নি। এগুলোর যেন ঘরে ফেরার তাড়া নেই। দৃষ্টিসীমায় কোনো মানুষও দেখা গেল না।
দৃশ্যটা গত ১৬ মে, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের উত্তরে নতুন জেগে ওঠা সবুজচরের। আসলে এসব গবাদিপশু দিনরাত এই চরে থাকে, ঘাস খায়, ঘুমায়। চৈত্র বা বৈশাখে গবাদিপশুগুলোকে ‘ধাওয়া’ করে মাঠে পাঠানো হয়। ফের আমনের মৌসুম শুরু হওয়া পর্যন্ত সেখানে তারা থাকবে। আর আমন মৌসুমের চার মাসে তাদের স্থান হবে অন্য কোনো পতিত চর বা ডুবোচরে। ধাওয়া দিয়ে গবাদিপশু পালনের এই পদ্ধতি ধাওয়ানি বা ধাবানি হিসেবে সন্দ্বীপে পরিচিত।
গত ১৪ থেকে ১৬ মে সন্দ্বীপ ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ধাবানি সম্পর্কে জানা গেল। স্থানীয় মানুষের ধারণা, ধাবানি–পদ্ধতিতে পশুপালনের শুরুটা অন্তত দুই শ বছর আগে। এখন যত বেশি নতুন চর জেগে উঠছে, ততই ধাবানি পশুর বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
সন্দ্বীপ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, কয়েক বছর ধরে কোরবানির ঈদে গবাদিপশু সন্দ্বীপ থেকে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। প্রতিবছর গড়ে সংখ্যাটা ৫০ হাজার। যা এই দুই এলাকার কোরবানির পশুর চাহিদার ২০ শতাংশের মতো।
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এ বছর ৮০ হাজার গবাদিপশু প্রস্তুত আছে বলে কর্মকর্তারা বলেছেন। যার মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার ধাবানির পশু। ধাবানির পশুর মধ্যে রয়েছে গরু, মহিষ ও ভেড়া। এসব পশুর সম্ভাব্য বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি।
পুরোপুরি প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে এসব পশু। ফলে ধাবানির পশুর চাহিদাও বেশি বলে উল্লেখ করেন সন্দ্বীপ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজম। তিনি বলেন, পতিত জমি ও চরে পুরোনো এই পদ্ধতিতে গবাদিপশু পালন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন সন্দ্বীপের পশুপালকেরা। প্রতিবছর সব ধরনের গবাদিপশু বিক্রি করে সন্দ্বীপের পশুপালকেরা অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আয় করেন।
গত ১৪ থেকে ১৬ মে সন্দ্বীপ ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ধাবানি সম্পর্কে জানা গেল। স্থানীয় মানুষের ধারণা, ধাবানি–পদ্ধতিতে পশুপালনের শুরুটা অন্তত দুই শ বছর আগে। এখন যত বেশি নতুন চর জেগে উঠছে, ততই ধাবানি পশুর বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
সন্দ্বীপের সন্তোষপুর ইউনিয়নের পশুপালক আকবর আলীর (৪৫) ধাবানির গরু রয়েছে ৫০টি। তিনি বলেন, ধাবানি–পদ্ধতিতে পশুপালনে বাড়তি খরচ হয় না। একবার চরে ছেড়ে দিলে নিজেদের খাবার নিজেরাই জোগাড় করে পশু। ফলে ভালো আয় করা যায়। একসময় তাঁর অবস্থা ভালো ছিল না, বছর দশেক আগে এই পদ্ধতিতে পশু পালন করে তিনি এখন সচ্ছল।
২০–২২ বছর ধরে ধাবানির গরু–মহিষ পালন করে আসছেন পশুপালক মোহাম্মদ আফছার (৫৪)। মাস দেড়েক আগে তিনি ১২টি মহিষ বিক্রি করেছিলেন। গড়ে প্রতিটির দাম পেয়েছেন ৯০ হাজার টাকা। এসব মহিষ তিনি নতুন করে কেনেননি। মহিষগুলো চরেই জন্ম নিয়ে সেখানে বেড়ে উঠেছে।
চরে ছেড়ে দেওয়ার পর পশুগুলো কীভাবে চেনা যায় বা বিক্রির সময় কীভাবে নেওয়া হয়, সে সম্পর্কে মোহাম্মদ আফসার জানান, গবাদিপশুর কানে দাগ দেওয়া থাকে। একেকজনের গরু–মহিষে থাকে একেক ধরনের দাগ।
সন্দ্বীপ এখন ‘লাইভস্টক জোন’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে ভাঙনপ্রবণ দ্বীপ এবং নতুন জেগে ওঠা চরে পশুপালনের এই পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন প্রাণিবিদেরা।
সন্দ্বীপের কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র বলছে, সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ডের এক ফসলি কৃষিজমি লবণাক্ততা ও অন্যান্য কারণে বছরে সাত মাস পতিত থাকে। আমন ধান উঠে গেলেই এসব ভূমি এবং চর গরু-মহিষ আর ভেড়ার পালে ভরে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শুধু সবুজ চরে অন্তত ৩০ হাজার গবাদিপশু চরে বেড়ায়।
২০–২২ বছর ধরে ধাবানির গরু–মহিষ পালন করে আসছেন পশুপালক মোহাম্মদ আফছার (৫৪)। মাস দেড়েক আগে তিনি ১২টি মহিষ বিক্রি করেছিলেন। গড়ে প্রতিটির দাম পেয়েছেন ৯০ হাজার টাকা। এসব মহিষ তিনি নতুন করে কেনেননি। মহিষগুলো চরেই জন্ম নিয়ে সেখানে বেড়ে উঠেছে।
সন্দ্বীপের একটি দ্বীপ ইউনিয়ন হলো উড়িরচর। এই চরের বাসিন্দাদের প্রধান পেশা গবাদিপশু পালন। বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে নিম্নবিত্ত তার ঘরেও অন্তত পাঁচ–সাতটি গবাদিপশু আছে। গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এখন ঘরে–বাইরে পালন করা হচ্ছে।
পুরো সন্দ্বীপের চিত্র কমবেশি এমন বলে জানান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজম। তিনি বলেন, সন্দ্বীপ আসলে প্রাণিসম্পদের বিচরণক্ষেত্র বা ‘লাইভস্টক জোন’। ২০১৮ সালে এখানে গবাদিপশু ছিল প্রায় ৫ লাখ ১৬ হাজার। চলতি বছর পশুশুমারির কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে সংখ্যাটা সাত লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
দরকার সহায়তা
সন্দ্বীপে প্রাকৃতিকভাবে পশুপালন বাড়লেও কিছু সমস্যার দিকও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণীদের আশ্রয়ের জন্য কিল্লা (মাটির উঁচু ঢিবি, গবাদিপশুর আশ্রয়স্থান) এবং সুপেয় পানির জন্য পুকুর দরকার; কিন্তু সন্দ্বীপের সবুজচরে কোনো কিল্লা বা পুকুর নেই। উড়িরচরে সম্প্রতি একটি কিল্লা গড়ে তোলা হয়েছে।
সন্দ্বীপ পশুপালনের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। এখানে পশুপালনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা দরকার। কিল্লা এবং উঁচু পাড়বিশিষ্ট পুকুর খনন করা দরকার; কিন্তু বরাদ্দ হয়েছে মোটে দুটি কিল্লারসন্দ্বীপ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজম
সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী আবুল কাশেম বলেন, ধাবানির পশু বিচরণের চরগুলো সন্দ্বীপের বেড়িবাঁধের বাইরে। ফলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারে চরগুলো প্লাবিত হয়। এ সময় গবাদিপশুগুলো বিপদে পড়ে। আর সাগরের লোনাপানি পশু খেতে পারে না। বাধ্য হয়ে খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ঊর্ধ্বতন মহলে বারবার তাগাদা দিয়ে সরকারিভাবে উড়িরচরে একটি কিল্লার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আরেকটির বন্দোবস্ত হয়েছে। তবে প্রয়োজন আরও অনেক বেশি বলে জানান সন্দ্বীপ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্দ্বীপ পশুপালনের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। এখানে পশুপালনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা দরকার। কিল্লা এবং উঁচু পাড়বিশিষ্ট পুকুর খনন করা দরকার; কিন্তু বরাদ্দ হয়েছে মোটে দুটি কিল্লার।’
উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নামে সরকারের একটি কর্মসূচি চলমান আছে। সেই প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট খামারিদের সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হয়।
দেশকে প্রাণিসম্পদে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ধাবানি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে উল্লেখ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, এই কর্মসূচি থেকে চরগুলোতে কিল্লা এবং সুপেয় পানির জন্য পুকুর খনন করে সেগুলোর পাড় উঁচু করলে গবাদিপশু পালন আরও বাড়বে।