নারীর প্রতি সহিংসতা
সাইবার-জগতেও নারী ‘সহজ লক্ষ্য’
সাইবার-জগতে নারীর প্রতি সহিংসতায় সাবেক স্বামী–প্রেমিক, সহপাঠী-বন্ধু, প্রতিবেশী থেকে অপরিচিত বা অনলাইনে হওয়া বন্ধু—কেউ পিছিয়ে নেই।
দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা জুলাইয়ের অভ্যুত্থান। এতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। সেই সময়েও রাজপথে নামা অনেক নারী সাইবার সহিংসতার শিকার হন।
সম্প্রতি কয়েক দফায় গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, দৃঢ় মনোভাবের কারণে তাঁরা গুলির সামনে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। সেই কঠিন সময়েও তাঁরা অনলাইনে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন; তাঁদের নিয়ে বিকৃত ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। এতে মনোবল টলে গিয়েছিল তাঁদের, বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া এক নারী এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিং করে তাতে ‘হেট কমেন্ট’ করা হতো, বিকৃত ভিডিও তৈরি করা হতো। সেসব নিয়ে প্রতিবেশীরা তাঁর মা–বাবাকেও উত্ত্যক্ত করা শুরু করেছিলেন। তবে মা–বাবা সেসব উপেক্ষা করে তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আরেক নারী বলেন, তাঁর এক সহপাঠী হয়রানি সহ্য করতে না পেরে আন্দোলন–পরবর্তী সব কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ান।
একদিকে আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে নারীদের নেতৃত্বের পর্যায়ে গুরুত্ব না দেওয়া, অন্যদিকে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির কারণে অনেক নারী নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। পুলিশের প্রতিবেদনও বলছে, গত বছর সাইবার হয়রানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসে আন্দোলন–পরবর্তী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে।
পুলিশ সদর দপ্তর পরিচালিত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে ৯ হাজার ১১৭টি হয়রানির অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৭১৫, ফেব্রুয়ারিতে ৬৫৩, মার্চে ৭২৩, এপ্রিলে ৭৩০, মে মাসে ৭৭৩, জুনে ৮৪২, জুলাইয়ে ৭১০, আগস্টে ৬৩০, সেপ্টেম্বরে ৯৭৯, অক্টোবরে ৮৮১, নভেম্বরে ৭১৪ ও ডিসেম্বরে ৭৬৭টি অভিযোগ আসে।
‘সাইবার সহিংসতার শিকার নারীদের মনো-সামাজিক পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল্যায়ন’ শিরোনামের এক পিএইচডি গবেষণায় বলা হয়েছে, সাবেক প্রেমিকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সাইবার সহিংসতার শিকার হয়েছেন মেয়েরা।
দেখা যাচ্ছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে নারীকে হেনস্তা করার, ঘায়েল করার ‘সহজ অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে সাইবার জগৎকে। সাইবার জগতে নারীর প্রতি সহিংসতায় পরিচিত-অপরিচিত, সাবেক স্বামী, সাবেক প্রেমিক, অনলাইন বন্ধু, সহপাঠী-বন্ধু, প্রতিবেশী কেউ পিছিয়ে নেই।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার জগতে মেয়েদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আইন হচ্ছে; কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নারীর দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে—এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের উচিত এখন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মনোযোগ দেওয়া।
সাইবার জগতে মেয়েদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আইন হচ্ছে; কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
পরিচিত–অপরিচিত—অপরাধে কেউ পিছিয়ে নেই
গত বছরের নভেম্বরে ঝিনাইদহের কলেজপড়ুয়া একটি মেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে বন্ধু হওয়ার অনুরোধ পেয়ে তা গ্রহণ করেন। অ্যাকাউন্টটি মেয়ের নামে হলেও কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় (চ্যাট) মেয়েটি বুঝতে পারেন, এটা কোনো ছেলের অ্যাকাউন্ট। একপর্যায়ে মেয়েটির ছবির মুখাবয়ব নিয়ে নগ্ন ভিডিও বানিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে হয়রানি করা হতে থাকে।
গত ৮ জানুয়ারি থেকে সপ্তাহজুড়ে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায় ৮ স্কুলছাত্রীসহ ১৩ জনের ছবি দিয়ে পর্নো ভিডিও তৈরি করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছে টাকা দাবি করা হয়। ঘটনার শিকার এক মা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বড় মেয়ের (১৬) মুখাবয়ব ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও করে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে পরে তাঁর ও তাঁর ছোট মেয়ের (১১) ভুয়া পর্নো ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রুপে। অপরাধী শনাক্ত হওয়ার আগে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার আর সহ্য হচ্ছে না। কিছুদিন এভাবে চললে মরেই যাব।’
ওই ঘটনায় মেসেঞ্জার গ্রুপে প্রতিবাদ করে সাইবার সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন অধিকারকর্মী তাসলিমা তিন্নি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নিজে আক্রান্ত হওয়ার পর আমি ভুক্তভোগীদের কষ্ট গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। নিজেকে আমি শক্ত ভাবতাম। সেই আমিও প্রচণ্ড বিষণ্ন আর হতাশ বোধ করছিলাম। সাইবার সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রচারাভিযান ও অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।’
পিএইচডির জন্য করা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯০ শতাংশ অনলাইন সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ করা হয় না।
ঝিনাইদহ ও টাঙ্গাইলের দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা স্থানীয় থানা ও পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগ করেন। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী এক তরুণ এবং দ্বিতীয় ঘটনায় সমবয়সী কিশোরী সহপাঠীকে অভিযুক্ত হিসেবে শনাক্ত করে পিসিএসডব্লিউ। স্থানীয় থানা–পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করেছে।
মাগুরার এক নারীর একান্ত ব্যক্তিগত ছবির সঙ্গে তাঁর মুঠোফোন নম্বর ও ঠিকানা ফেসবুকে পোস্ট করে হয়রানি করা হয়। ওই ঘটনায় তাঁর সাবেক স্বামীকে শনাক্ত করে পিসিএসডব্লিউ।
নীলফামারীর এক কলেজছাত্রী পিসিএসডব্লিউয়ে অভিযোগ করেন, তাঁর ব্যক্তিগত ছবি ও ফেসবুক অ্যাকাউন্টের লিংক টেলিগ্রাম গ্রুপ ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই ঘটনায় সাবেক প্রেমিককে অভিযুক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এ দুটি ঘটনায়ও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আটক হয়েছেন।
‘সাইবার সহিংসতার শিকার নারীদের মনো-সামাজিক পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল্যায়ন’ শিরোনামের এক পিএইচডি গবেষণায় বলা হয়েছে, সাবেক প্রেমিকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সাইবার সহিংসতার শিকার হয়েছেন মেয়েরা। এ হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। অনলাইন বন্ধুর মাধ্যমে ২০ শতাংশ, অপরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ১৬ শতাংশ, সাবেক স্বামীর মাধ্যমে ১২ শতাংশ, বন্ধুর মাধ্যমে ৮ শতাংশ, সহকর্মী ও সহপাঠীর মাধ্যমে ৬ শতাংশ এবং স্বজনদের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশই শহরের বাসিন্দা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, প্রায় ২৯ শতাংশ সরকারি ও ২০ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী এবং ১২ শতাংশ গৃহিণী।
গবেষণাটির সময়কাল ছিল ২০২১–২২ সাল। এটি প্রকাশিত হয় গত বছরের নভেম্বরে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুকের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি করেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোকসানা সিদ্দীকা।
যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, অবশ্যই আপনারা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবেন।ইনামুল হক, পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি)
যত হয়রানি তত অভিযোগ নেই
টাঙ্গাইলের ঘটনায় আরেক স্কুলছাত্রীর মা বলেছিলেন, মানসম্মানের ভয়ে তিনি মামলা করতে চাননি। তাঁর ভাষায়, ‘আপনি–আমি বুঝতে পারছি, এটা ভুয়া ভিডিও। কিন্তু সবাই এভাবে বুঝতে চায় না। এই ভিডিও যদি মেয়ের বিয়ের সময় ছড়িয়ে দেয়! আমার মেয়ের তো জীবন শেষ হয়ে যাবে!’
পিসিএসডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪২ হাজার ৬৪২টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে এক–তৃতীয়াংশ অভিযোগকারীই পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
পিএইচডির জন্য করা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯০ শতাংশ অনলাইন সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ করা হয় না। আইনি সহায়তার অভাবে ২৫ শতাংশ, হয়রানির ভয়ে ২৩ শতাংশ এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন না। বিচার পর্যালোচনার জন্য পুলিশের কাছে নথিভুক্ত ১ হাজার ১৮৯টি মামলার মধ্য থেকে ১৪৭টি মামলা নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের ৫২০টি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩২৮টিই ঝরে পড়েছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১৪৭ জনের মধ্যে ৬১ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা করেছেন। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের করা মামলায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সাইবার অপরাধের তদন্ত জটিলতা, প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়া, কার্যকর ও সক্ষমতার সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া না হওয়ার কারণে আসামির সাজা হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, অবশ্যই আপনারা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবেন। অভিযোগ না পেলে পুলিশের পক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। পিসিএসডব্লিউতে নারী পুলিশেরা সহায়তা দিয়ে থাকেন। অন্তত সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে অভিযোগ জানাতে পারবেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীদের বিচারের প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য থানাগুলোকে আধুনিক করার তাগিদ দেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) উপদেষ্টা সালমা আলী।
থানাগুলোকে আধুনিক করার তাগিদ
সাইবার সহিংসতা ও পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এবং ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের বিচারের প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য থানাগুলোকে আধুনিক করার তাগিদ দেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) উপদেষ্টা সালমা আলী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা থানাগুলোর নেই। তাই কীভাবে ভুক্তভোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করতে হবে, কীভাবে অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে হবে, সে জন্য পুলিশকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।