স্মার্ট কিচেন গ্যাজেট, পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকসহ আরও নানা উদ্ভাবন নিয়ে খুদে বিজ্ঞানীদের মিলনমেলা

বিজ্ঞান উৎসবে প্রদর্শন করা বিভিন্ন প্রজেক্ট সম্পর্কে জানছে শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

কুইজ শেষ করে আপনমনে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে ঘুরছিল শৈস্য সরকার সংহ। পদার্থবিদ হতে চাওয়া এই খুদে বিজ্ঞানীর মনে ধরেছে রোবট শো। রোবটের দেওয়া উদ্বোধনী আয়োজনের ঘোষণা তার কাছে ছিল চমক। শৈস্য এখন থেকেই ‘বিজ্ঞানী’। কারণ, একজন অণুজীববিজ্ঞানী বলেছেন, জীবনে দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে সবাই বিজ্ঞানী।

আজ সোমবার রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিকাশ–বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসব। সাতটি আঞ্চলিক পর্ব শেষে আজ ছিল জাতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। কুড়িগ্রাম থেকে বাবার সঙ্গে আসা শৈস্যের মতো তিন শতাধিক খুদে বিজ্ঞানীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল শিশু একডেমি চত্বর। নানা আয়োজনে দিনটি ছিল উৎসবমুখর।

বিজ্ঞান উৎসবের আয়োজন করছে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও সর্বাধিক পঠিত বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা।

পতাকা উড়িয়ে উৎসব উদ্বোধন করছেন আয়োজক ও অতিথিরা। বাঁ থেকে শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটকক্স অ্যান্ড মেকানিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম ও প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ
পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে রাজধানীর শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের সিরাজাম মুনিরা, সানজিদা মাসুম ও সুমাইয়া আফরিন ‘পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক’ তৈরি করেছে।

উদ্বোধনী পর্বে প্রচলিত রীতিতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, বেলুন ওড়ানো, অতিথিদের বক্তব্য—সবই ছিল। কিন্তু উদ্বোধনের ঘোষণাটি এসেছে রোবট ‘নাও’–এর কাছ থেকে। এ পর্বে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, এই শিশুদের মধ্যেই ভবিষ্যতের বড় বিজ্ঞানী আছে। তাদের সুযোগ এখন অনেক বেশি। বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জীবনে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম। আর বিজ্ঞান উৎসবের মতো আয়োজন শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দেয় বলে উল্লেখ করেন শিশু একাডেমির মহাপরিচালক ও ছড়াকার আনজীর লিটন।

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেন, সামনের দিনগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। সেখানে এগিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার হচ্ছে এসব শিশু। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।

এরপর শুরু হয় কুইজ। নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক—দুটি শ্রেণিতে ছিল এই প্রতিযোগিতা। দুই শ্রেণি মিলিয়ে ১০ জন পুরস্কার জেতে। আরও ছিল সবার জন্য বিশেষ কুইজ প্রতিযোগিতা। এই কুইজে ১০ জন পুরস্কার পায়। এ ছাড়া সুডোকুর ছয়জন বিজয়ীও পুরস্কার পেয়েছে।

বক্তব্য, কুইজ বা নানা প্রতিযোগিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি জাতীয় এই উৎসব। ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকানিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিডিওএসএনের কো–অর্ডিনেটর মাহেরুল আজম কোরেশীর পরিবেশন করা রোবট শো; গুফির পাপেট শো; মনি কুন্তলা, অটামনাল মুন ও আন্তনগরের গান; পূজা সেনগুপ্ত ও তাঁর দলের নাচ।

খুদে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন

সকাল থেকেই স্টল গোছানো শুরু করে খুদে বিজ্ঞানীরা। সারা দেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের তৈরি করা ‘প্রজেক্ট’ উৎসবে প্রদর্শন করে। সড়ক দুর্ঘটনা, সিলিন্ডার বিস্ফোরণসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ে মানুষ এখন আতঙ্কে থাকে। এসব দুর্ঘটনা রোধের নানা উপায় বের করেছে এই বিজ্ঞানীরা।

সিলেটের বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী শ্রাবণ তালুকদার ও শুভ তালুকদার। তারা বানিয়েছে ‘স্মার্ট কিচেন গ্যাজেট’। তাদের ভাষ্য, যদি বাসায় গ্যাস লিক হয়ে বের হতে থাকে, তবে এই গ্যাজেট সংকেত দিতে থাকবে। পাশাপাশি মুঠোফোনে একটি কলও চলে যাবে। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় ফ্যান চালু হয়ে গ্যাস বের করে দিতে সাহায্য করবে।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে আসা নূর আহমেদ ও আবদুল হাদী ‘স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ তৈরি করেছে। তাদের এই ব্যবস্থায় কোথাও গ্যাস লিক হলে কাছাকাছি ফায়ার স্টেশনে এসএমএস বা কল চলে যাবে। তারা নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের উপায়ও বানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে চালকের গাড়ি চালানোর বিষয়টি সার্বক্ষণিক নজরদারি করা যাবে। চালক যদি অতিরিক্ত গতি বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালান, তবে সংকেত চলে যাবে সংশ্লিষ্টদের কাছে।

রোবটের নানা অঙ্গভঙ্গি। পরে উৎসব উদ্বোধন করে রোবটটি।

পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে রাজধানীর শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের সিরাজাম মুনিরা, সানজিদা মাসুম ও সুমাইয়া আফরিন ‘পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক’ তৈরি করেছে। তাদের ভাষ্য, মাশরুমের নিচে থাকা মাইসেলিয়াম দিয়ে প্লাস্টিক তৈরি করে তা ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব। পাশাপাশি তা সার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

জাতীয় পর্বে অংশ নেওয়া প্রজেক্টগুলোর পাঁচটিকে সেরা প্রজেক্ট হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের দেওয়া হয়েছে ল্যাপটপ, বই, বিজ্ঞান বাক্স, ট্রফি, মেডেল, সনদসহ আরও নানা পুরস্কার।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দিতে উৎসবে যোগ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে তাঁর আগ্রহের কথা শোনান শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া জানান, সময় পেলেই তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, যে যা–ই হোক না কেন, নিজের আত্মপরিচয় ধরে রাখতে হবে। নিজ পরিচয়ে বিকশিত হতে হবে।

আরও পড়ুন

ছিল আরও আয়োজন

বিজ্ঞান মানে কারও কোনো কথা বিশ্বাস না করে নিজে প্রমাণ আদায় করে সত্যটা জানা। কথাগুলো শিক্ষার্থীদের বলেন অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তিনি আরও বলেন, ‘দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে আমরা যেসব কাজ করি, তার মধ্যেই বিজ্ঞান আছে। সবাই বিজ্ঞান চর্চা করে। অর্থাৎ সবাই বিজ্ঞানী।’

সরকারি চাকরিজীবী খায়রুল আলম খুলনা থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। কুইজে আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পর্বে অংশ নিয়েছিল তাঁর ছেলে আমিরুন নাহিম। খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে যেসব আয়োজনে যেতে চায়, তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। কারণ, এসব জায়গা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। পড়াশোনার প্রতি একঘেয়েমি কাটে এবং মনোযোগ বাড়ে।  

শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে। তা ঘুরে ঘুরে দেখছে সবাই।

বক্তব্য, কুইজ বা নানা প্রতিযোগিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি জাতীয় এই উৎসব। ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকানিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিডিওএসএনের কো–অর্ডিনেটর মাহেরুল আজম কোরেশীর পরিবেশন করা রোবট শো; গুফির পাপেট শো; মনি কুন্তলা, অটামনাল মুন ও আন্তনগরের গান; পূজা সেনগুপ্ত ও তাঁর দলের নাচ। এ ছাড়া জাদু দেখিয়ে খুদে বিজ্ঞানীদের আনন্দ দেন জাদুকর স্বপন দীনার।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞান উৎসব মানেই যত অজানাকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা। কার মনে কত প্রশ্ন আছে, সেসবের উত্তর খোঁজা। বাদ যায়নি সে পর্বও। এই যেমন মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী ঘুমালে কি স্বপ্ন দেখে? মাইক্রোবায়োস্কোপ চোখের ক্ষতি করে? অথবা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী জিনগত রোগ বহন করে? সময় শেষ হলেও প্রশ্ন যেন শেষ হয় না।

এক শিক্ষার্থীর প্রজেক্ট।

শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে কৌতূহল মেটান ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন ও  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক এ কে এম আবদুল হাকিম, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সৌমিত্র চক্রবর্তী ও বিজ্ঞানবক্তা আসিফ।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞানের প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করতে ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে এ ধরনের আয়োজন করা হয় বলে জানান বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে খুদে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে আরও বক্তব্য দেন রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদের সম্পাদক আহসান হাবীব, পাখিবিশেষজ্ঞ শরীফ খান, বিকাশের ইভিপি ও হেড অব রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, অভিনেত্রী সাবিলা নূর, ভারোত্তোলক মারিয়া আক্তার সীমান্ত, অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন হাফিজ মুহম্মদ হাসান প্রমুখ।

আরও পড়ুন