অন্য রকম মা-সন্তানদের অন্য রকম ঈদ
‘আম্মু, আম্মু...’। সাড়ে চার বছরের জুবায়ের আবেগ জড়ানো কণ্ঠে মাকে ডাকছিল। পাশের ঘর থেকে মা আসতেই দৌড়ে কাছে গেল শিশুটি।
ছোট্ট হাতে মাকে ধরে শিশুটির মুখের একগাল হাসি যেন থামছেই না। অথচ শুধু জুবায়ের নয়, তার বাকি পাঁচ ভাই-বোন ও বেতনভুক মাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তারা কেউই রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। এক দিন, দুই দিন করে এই মায়ার শিকড় এতটাই শক্ত হয় যে তা আজীবন থেকে যায়।
ঈদের প্রস্তুতি কেমন হলো? কীভাবে কাটবে এবারের ঈদ? সেসব জানতে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লিতে যাওয়া। ‘জোনাকী’ নামের বাড়ির মা, অর্থাৎ জুবায়েরের মায়ের নাম নাদিরা খাতুন। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তিনি বারবার তার ছয় সন্তানের গুণের কথা বলছিলেন। কোন মেয়ে রান্না ভালো পারে, কোন ছেলে খেলাধুলায় ভালো— এসব বলাতেই যেন তাঁর রাজ্যের আনন্দ।
জানতে চাইলাম, ঈদের কেনাকাটা শেষ? নাদিরা খাতুন বলেন, ‘হ্যাঁ, কেনা হয়েছে। আসলে এক দিনে সবাইকে নিয়ে তো বের হওয়া যায় না। সময় করে কয়েক দিনে বের হয়েছিলাম।’
সন্তানের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েই পোশাক কিনে দেন এই মা। ছেলেদের পাঞ্জাবি ও শার্ট মার্কেট থেকেই কিনেছেন। ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তিসচেতন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। আমার বড় মেয়ে অনলাইনেই পোশাক পছন্দ করে রাখে। সেখান থেকেও অর্ডার করি।’
মুঠোফোনে মেহেদির নকশা ঠিক করে রেখেছে এক মেয়ে। এমনকি কোন মেয়ে মায়ের হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেবে, সেটা নিয়েও আছে প্রতিযোগিতা। তাই মেহেদির কথা বলেই হেসে ফেলেন নাদিরা খাতুন।
মায়ের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলে মো. ইয়ামিন হাজির। সে–ও নিজের ঈদ উদ্যাপন নিয়ে বলতে চায়। আগ্রহ দেখে প্রশ্ন করলাম, ঈদ মানে কী? ঝটপট উত্তর, ‘খুশি ও আনন্দ।’
আনন্দ করতে এবার কী কী কিনেছ, জিজ্ঞাসা করতেই ইয়ামিন বলে, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, গেঞ্জি, জুতা।
ঢাকার এসওএস হারমান মেইনার কলেজের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এই শিশুটি। ঈদের দিনে কী করবে, সে পরিকল্পনাও সাজিয়ে রেখেছে ইয়ামিন। পছন্দের পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়ে প্রিয় খাবার সেমাই খেতে চায় সে। এরপর বড় আপুদের ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলবে। বিকেলে মেলা দেখতে শ্যামলী মাঠে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার।
ইয়ামিনের কথা ধরে বড় আপুর প্রসঙ্গ তুলতেই তার মা হাসিমুখে বললেন, হোস্টেল থেকে ওদের আপুরা আসে। যাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাঁরাও বউ বা জামাই নিয়ে আসে।
উৎসব উপলক্ষে এই পল্লিতে আগের দিন থেকেই বাড়ি পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়। ঈদের দিন সকালে গোসল করে শিশুদের নতুন পোশাক পরিয়ে দেন মা। বড় আপুরাও সাহায্য করেন। ছোট ভাই-বোনদের সাজিয়ে দেন তাঁরা। এর মধ্যে রান্নাবান্নার কাজও এগোতে থাকে। ছেলেরা নামাজ পড়ে এসেই পছন্দের খাবার খায়। এখানে ইয়ামিনদের মতো অনেকেরই খাবারের তালিকার ওপরের দিকে আছে পুডিং, সেমাই, পায়েস, ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ফ্রাই। এরপর পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে যায় এই শিশুরা। অন্য মায়েদের সালাম করে। অনেকে পরিবারসহ ঘুরতে যায় জাতীয় চিড়িয়াখানা ও শিশুমেলায়।
‘সন্ধানী’ বাড়ির মেয়ে মাইশা ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। সে–ও এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাইশা জানায়, আড়ং থেকে থ্রি–পিস কিনেছে সে। ঈদের দিন পরবে; কিন্তু পোশাক আগে দেখিয়ে ঈদ নষ্ট করতে খুব একটা আগ্রহী নয় সে।
তবে ইয়ামিন, জান্নাতুল ফেরদৌস ও শান ইসলামকে বলতেই তারা নিজেদের পোশাক নিয়ে হাজির। কার পাঞ্জাবি সুন্দর সেটি নিয়ে চলে খুনসুটিও।
শিশুপল্লির পাড়া
জুবায়েরদের বাড়ির নাম ‘জোনাকী’, পাড়ার নাম ‘দিশারি’। শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লিতে এ রকম মমতাপাড়া, সোনালিপাড়া ও দিশারিপাড়া নামে তিনটি পাড়া আছে। প্রতিটি পাড়ায় ৫টি করে মোট ১৫টি বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে একটি করে পরিবারের বাস।
অবিকল একই রকম দেখতে লাল ইটের ডুপ্লেক্স বাড়িগুলোর নাম সোনালি, রুপালি, পুবালি, কাকলি, শ্যামলী, মমতা, সমতা, জনতা, একতা, সততা, দিশারি, রূপসী, মায়াবী, জোনাকি ও সন্ধানী। সব ঘরেই রয়েছে প্রয়োজনীয় আসবাব ও ফার্নিচার।
সিমেন্টের আঁকাবাঁকা ছোট রাস্তা দিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হয়। বাড়িগুলোর চারপাশে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, সুপারিসহ বড় বড় গাছে ঘেরা এই পল্লি। এক পাশে সবুজ ঘাসের বড় মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল খেলে শিশুরা।
বর্তমানে এই পল্লিতে ১৫ জন মায়ের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ৯২ জন। সবাই এখানে ভাই-বোন। এখানকার শিশুদের একটি বড় অংশই মা-বাবাহারা। বাকিরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে অভিভাবকের স্নেহবঞ্চিত পরিবারহীন ছিল। তবে এখন আর সেসব কথা তাদের মনে করতে দেওয়া হয় না। অন্য সাধারণ পরিবারের মতো তারা মা-ভাইবোন মিলে হইহুল্লোড় করে বেড়ে উঠছে।
মা অসুস্থ হলে শিশুদের দায়িত্ব নেন খালারা। তাঁরাও মায়ের মতোই বেতনভুক। মা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে খালা হয়ে কাজ করতে হয়। একে প্রশিক্ষণের অংশও বলা যায়। বেতনভুক মায়েরা চাকরি করতেই এখানে আসেন। তবে নিজের অজান্তেই একসময় তাঁরা অনেকগুলো সন্তানের মা হয়ে যান। হয়ে ওঠেন সন্তানের চাওয়া-পাওয়া, আবদার মেটানোর আশ্রয়স্থল। কোনো মায়েরা ১৫-২০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে আছেন। তাঁদের কাছে মানুষ হওয়া সন্তানের সংখ্যাও বেশি।
সোনালি পাড়ার মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর বর্তমান সন্তান সংখ্যা সাতজন; কিন্তু তিনি প্রথমেই জানিয়ে রাখলেন, তাঁর মোট ৩০ জন ছেলে–মেয়ে। মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউমা, নাতি নাতনি নিয়ে তাঁর এই বড় সংসার। এই যে টেবিল, ঈদের সময় খেতে বসলে এ রকম দুটি টেবিল দিয়েও এখন হয় না।
ফাতেমা বেগমের বাড়িতে ঝাল খাবার বেশি চলে। পোলাও, মাংস আর বিরিয়ানি শিশুরা খেতে চায়। ঈদের আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, আগের ছেলেমেয়েরাও আসবে। সবার পছন্দের খাবার তৈরি করবেন তিনি। ভালো দিন কাটবে সবার। আগের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিশুদের সম্পর্ক খুবই ভালো। তাঁদের পারিবারিক গ্রুপ আছে। সেখানেও কথা হয়। অনেকে উপহার নিয়ে আসে।
শিশুপল্লির আলো-বাতাসে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েদের অনেকেই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কেউ ডাক্তার হয়েছেন, কেউ শিক্ষক, কেউ পড়ছেন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন উৎসবে তাঁরা শুধু মাকে দেখতেই আসেন না, অনেকে মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান।
নিত্যদিনের রুটিন
এখন ঈদের ছুটিতে সবাই ছুটির মেজাজেই আছে। তবে অন্য সময় খুবই ব্যস্ত কাটে সবার। সকালে উঠেই আরবি শেখে অনেক শিশু। এরপর সকালের নাশতা করে ছুটতে হয় স্কুলে। তাই এর আগেই শিশুকে ঘুম থেকে ওঠানো, পোশাক পরিয়ে প্রস্তুত করা ও টিফিন বানান মায়েরা।
সন্তানকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে বাড়ির বাকি কাজে মনোযোগ দেন মায়েরা। এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ ও আশপাশের ভালো স্কুলে পড়েন এই পল্লির শিশুরা। তাই নিয়মিত পড়াশোনার বিকল্প নেই। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া ও বিশ্রামের সময় নির্দিষ্ট। দুপুর না গড়াতেই পল্লির ভেতরে শিক্ষকের কাছে পড়তে হয় টিউশন। বিকেলে খেলাধুলার জন্য মাঠে যায় শিশুরা। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে নাশতা খেয়েই পড়তে বসা। রাতে কেউ কম্পিউটার চালায়। তবে ১১টার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়াই এখানকার রীতি।
ছুটির দিনে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নাচ, গান, ড্রয়িং শেখে ছেলেমেয়েরা। খেলাধুলায় আগ্রহী হলে সেদিকে মন দেওয়ারও সুযোগ আছে। একটু বড় হলে নেতৃত্বের দক্ষতাসহ কম্পিউটারে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই শিশুদের।
পল্লিতে হিন্দু ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী শিশুদের জন্য আলাদা দুটি পরিবারে দুজন মা আছেন। এখানে তাদেরও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে।
এসওএস শিশুপল্লি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে কাজ করছে সংস্থাটি। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকাসহ বর্তমানে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও সিলেটে ছয়টি শিশু পল্লিসহ সংস্থাটির অন্যান্য কার্যক্রম চলছে।
কারা মা, কারা সন্তান
শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যয় বহন করে এসওএস শিশুপল্লি কর্তৃপক্ষ। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ সাহায্য করে।
এসওএস শিশুপল্লির ন্যাশনাল অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর মো. রাসেল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে সাধারণত ৬ বছরের কম বয়সী অভিভাবকহীন শিশুদের আনা হয়। আমরা কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিশুদের গ্রহণ করি। এখানে এসে একজন মায়ের কাছে সমাজের অন্য পরিবারের মতোই ভাই-বোনসহ তারা বড় হয়। এই মায়েদের আমরাই নিয়োগ দিই।’
সাধারণত বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, বিয়ে করবে না কিন্তু মাতৃত্বের চাহিদা আছে—এ রকম নারীদের মা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা আলাদা বেতন পান। অবসরের পর আছে পেনশনের সুবিধা। কোনো মা ইচ্ছা করলে শিশুপল্লির ভেতরে ‘মাদারস রিটায়ার্ড হোম’-এ থাকতে পারেন।
ছেলেরা ১৪ বছরের পর যুবপল্লিতে চলে যায়। মেয়েরা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এখানেই থাকে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গেলে তখন হল বা মেসে থাকতে হয়। তবে সেই খরচও বহন করে শিশুপল্লি।
এসওএস শিশুপল্লি ঢাকার প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের আনন্দ নিশ্চিতে যতটুকু সম্ভব, আমরা করে থাকি। একটা ভালো বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেটি দিয়ে মায়েরা সন্তানদের নিয়ে কেনাকাটা করেন। পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এগুলো সবই মা ও সন্তানেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো করেন।’
কিছু নিয়মনীতি মেনে পল্লির শিশুরা তাদের বাইরের বন্ধুদের বাসায় যেতে পারে। বন্ধুরাও মাসহ এখানে আসতে পারে। তবে অবশ্যই কারও তত্ত্বাবধানে এসব করতে হয়।
শিশুপল্লির সংখ্যা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, এমন প্রশ্নে ইউসুফ আলী বলেন, ‘শিশুপল্লি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। আমরা বরং কমিউনিটি প্রোগ্রামকে সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী করতে চাই। কারণ, কোনো প্রতিষ্ঠানে না রেখে নিজের পরিবারই শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা। মা-বাবা না থাকলে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন তো আছেই।’
পরিবার শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় শিশুদের শিক্ষা, দুপুরের খাবার, পরিবারের বড়দের কর্ম–প্রশিক্ষণ ও উপার্জনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো ইত্যাদি কাজ করে এই সংস্থা। একটি শিশু বা কিশোর-কিশোরী আত্মমর্যাদা নিয়ে বড় হবে, এটা নিশ্চিত করাই সংস্থাটির মূল লক্ষ্য। তাই তেমন একটা প্রচারমুখী নয় সংস্থাটি। তবে ছেলেমেয়েদের সুন্দর জীবন গঠনের পথকে মসৃণ করতে বিভিন্নভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা যায়। জাকাত, এককালীন দান ছাড়াও শিশুদের দায়িত্ব নিতে পারেন যে কেউ। সে ক্ষেত্রে একজন শিশুর আংশিক বা সম্পূর্ণ খরচ দিতে হবে। এর বাইরে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) থেকেও সহযোগিতা আশা করেন শিশুপল্লি–সংশ্লিষ্টরা।