ঢাকা থেকে ভাঙ্গায় ট্রেনভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে বাসের চেয়ে বেশি
আন্তনগর তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারে বসে (নন-এসি) ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে ভাড়া লাগে ৩৪৫ টাকা। এসি চেয়ারে ভাড়া ৬৫৬ টাকা। এই পথের দূরত্ব ৩২১ কিলোমিটার।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। এই গন্তব্যে যেতে আন্তনগর ট্রেনে (নন-এসি) ভাড়া গুনতে হতে পারে ৩৫০ টাকা। এসি চেয়ারে গেলে ৬৬৭ টাকা।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চলাচল করবে, সেগুলোর জন্য এমনই ভাড়া প্রস্তাব করেছে রেলওয়ের কমিটি। এখন প্রস্তাবটি রেল মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রস্তাবিত ভাড়া হারই অনুমোদিত হতে পারে। এমনটা হলে বাসের চেয়ে এই পথে ট্রেনের যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুনতে হবে।
রেল কর্তৃপক্ষের বিশ্লেষণে এসেছে, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নন-এসি বাসের ভাড়া ২৫০ টাকা। আর এসি বাসের ভাড়া ৫০০ টাকা।
ভাড়া প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে প্রতিটি গন্তব্যের বাস্তব দূরত্বের সঙ্গে পদ্মা সেতু ও গেন্ডারিয়া-কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের জন্য বাড়তি দূরত্ব যোগ করেছে রেলওয়ের কমিটি। এর ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-রাজশাহী পথের তুলনায় ঢাকা-ভাঙ্গা পথে যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব ধরা হয়েছে। একে রেলওয়ে পন্টেজ চার্জের জন্য বাড়তি দূরত্ব বলছে। আর গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের প্রতি কিলোমিটারকে ধরা হয়েছে ৫ কিলোমিটার। এ জন্যই ঢাকা থেকে ভাঙ্গার প্রকৃত দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার হলেও রেলওয়ে আদায় করতে চায় ৩৫৩ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন রেলপথ চালু হতে যাচ্ছে। কাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, এই রেলপথে আগামী নভেম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। শুরুতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে তিনটি ট্রেন চলাচল করতে পারে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে খুলনাগামী আন্তনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস পদ্মা সেতু হয়ে যাবে। ভাঙ্গা থেকে ট্রেনটি রাজবাড়ী, পাটুরিয়া, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ ও যশোর হয়ে খুলনায় যাবে। বর্তমানে ট্রেনটি বঙ্গবন্ধু সেতু, ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া হয়ে চলাচল করে।
অন্যদিকে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব রয়েছে। বর্তমানে রাজশাহী থেকে মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাঙ্গা পর্যন্ত চলাচল করে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনটি ঢাকা পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া ঢাকা-পদ্মা সেতু-রাজবাড়ী রুটে একটি কমিউটার ট্রেন চালানোর কথাও ভাবছে রেলওয়ে।
পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের অধীন ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
কাল ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের উদ্বোধন করা হবে। এর মধ্যে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার রেললাইন উড়ালপথে। আর আগামী বছর যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালুর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে রেলওয়ে।
পুরো রেলপথ চালু হলে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর দিয়ে ট্রেন খুলনায় যেতে পারবে। একইভাবে রাজবাড়ী হয়ে উত্তরবঙ্গের পথেও ট্রেন চলতে পারবে। ভবিষ্যতে বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর পায়রা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে সরকারের সেতু বিভাগ। এই সেতুর ওপর রেললাইন বসিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে ট্রেন চলাচলের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে টোল দিতে হবে। তবে এখনো এই টোল হার নিয়ে একমত হতে পারেনি সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটি।
ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এই পথে লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করবে। সেগুলোর ভাড়া অনেক কম হবে। আন্তনগর ট্রেনের ভাড়া কিছুটা বেশিই। তবে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথ চালু হয়ে গেলে ভাড়া কমে যাবে।
যেভাবে ভাড়া নির্ধারিত হবে
বর্তমানে রেলে কিলোমিটারপ্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ৯৫ পয়সা। নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ১৭ পয়সা।
দেশে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও আন্তনগর—এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ভাড়াহার কিছুটা কম-বেশি আছে।
এ ছাড়া আন্তনগর ট্রেনেও বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে। এগুলো হলো শোভন চেয়ার, এসি চেয়ার, এসি সিট ও এসি বার্থ (ঘুমিয়ে যাওয়ার আসন)।
লোকাল ট্রেনে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। আন্তনগরে তা ৩৫ টাকা। তবে সেতু ও উড়ালপথ থাকলে সর্বনিম্ন ভাড়া বাড়ে।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর ওপারের পদ্মা স্টেশনের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এই দূরত্বে শোভন চেয়ারের প্রস্তাবিত ভাড়া ৩৩০ টাকা। এসি চেয়ারের ভাড়া ৬৩৩ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ৭৫৯ টাকা।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, এখন ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে খুলনা রুটের ট্রেনগুলো চলাচল করে। এই রুটের ট্রেনগুলোকে অনেকটা পথ ঘুরতে হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু হয়ে চললে ঘুরতে হবে কম। ফলে যশোর ও খুলনার যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে সময় কম লাগবে, ভাড়াও বাড়বে না। তবে মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ বা নড়াইল যেতে হলে বেশি ভাড়া গুনতে হবে। একইভাবে মালামাল পরিবহনের ভাড়াও বাড়বে।
কমিটির কার্যক্রম
গত ২৪ সেপ্টেম্বর রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে চারটি দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দায়িত্ব চারটি হলো ১. পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারের জন্য বাড়তি কত কিলোমিটার যুক্ত করতে (পন্টেজ চার্জ) হবে, তা নির্ধারণ। ২. রেলওয়ের জন্য স্থায়ী একটা পন্টেজ চার্জ নির্ধারণের ফর্মুলা প্রস্তাব করা। ৩. পদ্মা সেতু দিয়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য ভাড়া নির্ধারণ। ৪. শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মালামাল পরিবহনের কামরার (লাগেজ ভ্যান) ভাড়া নির্ধারণ।
কমিটি ২ অক্টোবর রেলভবনে বৈঠক করে। ৪ অক্টোবর রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিটি বিদ্যমান চারটি সেতুর পন্টেজ চার্জ বিশ্লেষণ করে। তারা জানায়, বর্তমানে রেলে পন্টেজ চার্জ নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। তাই তারা সব দিক বিবেচনা করে পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারের জন্য বাড়তি ২৫ কিলোমিটার যোগ করার প্রস্তাব করছে। পাশাপাশি উড়ালপথকে সেতু বা ভায়াডাক্ট ধরে প্রতি কিলোমিটারকে বাড়তি ৫ কিলোমিটার বিবেচনা করেছে। ভবিষ্যতে সব নতুন সেতু ও ভায়াডাক্টের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে।
কমিটির প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুকে ১৫৪ কিলোমিটার রেলপথ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার উড়ালপথকে ১১৫ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলে বর্তমানে পাঁচটি সেতু পারাপারের ক্ষেত্রে বাড়তি কিলোমিটার যুক্ত করা হচ্ছে। তবে তা পদ্মা সেতুর মতো এত বেশি নয়।
৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুর ক্ষেত্রে ৮১ কিলোমিটার হিসেবে গণ্য করে ভাড়া আদায় করা হয়। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার সেতুর জন্য বাড়তি ধরা হয়েছে প্রায় পৌনে ১৭ কিলোমিটার।
১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হার্ডিঞ্জ সেতুর জন্য বাড়তি ধরা হচ্ছে ৪১ কিলোমিটার। এখানে প্রতি কিলোমিটার সেতুর জন্য বাড়তি ধরা হচ্ছে পৌনে ২৩ কিলোমিটার।
ভৈরব সেতুর দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটার। এর জন্য ভাড়া নেওয়া হয় ২৩ কিলোমিটারের। ব্রহ্মপুত্র সেতুর দৈর্ঘ্য দশমিক ৪ কিলোমিটার। এই সেতুর জন্য ১৬ কিলোমিটারের ভাড়া নেওয়া হয়।
রেলে সম্প্রতি চালু হয়েছে মালবাহী এসি কামরা (লাগেজ ভ্যান) সেবা। মালবাহী এসি কামরার ভাড়া নন-এসি কামরার দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করেছে কমিটি। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ইলেকট্রনিকস পণ্য ছাড়া অন্য মালামাল নন-এসি লাগেজ ভ্যানে পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতি কেজির জন্য ভাড়া আদায় করা হয় ২ টাকা ৩৫ পয়সা। সে হিসাবে এসি লাগেজ ভ্যানের ভাড়া কেজিপ্রতি ৪ টাকা ৭০ পয়সা হতে পারে।