নেতাকে সৎ ও আত্মসচেতন হতে হবে। সৎ ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণে কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে সমাজ। আর নেতৃত্ব বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলো ও বেসরকারি সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) আয়োজিত ‘সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সহযোগিতা দেয় ইউএসএইড ও কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনাল। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও লেখিকা আনোয়ারা আলম বলেন, সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। সমাজে যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিংয়ের মতো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এসবের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে কাজ করতে হবে।
নেতৃত্বকে একটি শিল্প উল্লেখ করে আনোয়ারা আলম বলেন, নেতাকে সমাজের উপকারের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি নেতৃত্বের বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওবায়দুল করিম বলেন, নেতাকে অন্যদের অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাঁর এমন কাজ করা উচিত, যাতে সমাজের দশজন মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে। একজন নেতার অন্যকে উৎসাহিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবীর এম নসরুল্লাহ বলেন, সমাজে যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তাঁর প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাঁকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে।
বিজয় সরণি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন ও মিলনরা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এরপর গত ২৫ বছর পর্যন্ত আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত কোনো ছাত্র সংগঠন নেই। ছাত্র আন্দোলনের বড় এই জায়গাটিকে মূল নেতৃত্ব গলা টিপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আগে নেতৃত্ব বিকাশে স্বয়ংক্রিয় কতগুলো ব্যবস্থা ছিল, যা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন যা রয়েছে, তাতে অপনেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।’
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, দেশে এত নির্বাচন হতে পারলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে না কেন? নেতৃত্ব বিকাশের এই স্বাভাবিক পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে না কেন?
সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণ রয়েছে। কারও কারও মধ্যে তা সুপ্ত থাকে। নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ করার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, নেতৃত্ব মানেই যে প্রভুত্ব নয়, সে বোধ একজন নেতার মধ্যে থাকতে হবে।
ইপসার ইয়ুথ লিডার মঈনুল হোসেন বলেন, ইপসা থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর প্রথম উদ্যোগ হিসেবে গ্রামের ভাঙা সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এলাকার যুবকদের একত্র করে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাস্তাটি সংস্কার করা হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় সমাজের নানা মহলের বাধা আসে বলে জানান তিনি। আবার সাধারণ গ্রামবাসীর অনেক সহযোগিতা পেয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলেয়া বেগম বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত ও হতদরিদ্র নারীদের উন্নয়নে যখন প্রথম কাজ শুরু করি, তখন অনেক বাধা পাই। তবে ইপসার লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর নিজের জড়তা দূর হয়।’
মিরসরাই ১৫ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন সেলিম বলেন, এলাকার উন্নয়ন করতে গেলে কিছু বাধা আসে। এসব উন্নয়নকাজে যদি তরুণদের ব্যবহার করা হলে বাধা কমে যাবে। এতে কাজে স্বচ্ছতা আসবে। অপচয়ও বন্ধ হবে।
ফাইট ফর উইমেন রাইটসের সভাপতি রেহানা বেগম বলেন, সৎ, যোগ্য, দক্ষ নেতৃত্ব না থাকলে সন্তান ও সম্পদ কোনোটিই রক্ষা করা যাবে না। সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সীতাকুণ্ড ১ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী বলেন, একসময় শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হতো। তাঁদের মোটিভেটেড করা হতো। সে অবস্থা আর নেই। তবে তরুণ ও যুবসমাজক বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথাসহ বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারবে। আশার কথা, অনেক ক্ষেত্রে তা করছেনও তাঁরা।
ইপসার প্রধান নির্বাহী মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘মানুষের চিন্তা ও মননের জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে না পারলে বারবার সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকবে। এতে করে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারিয়ে ফেলতে পারে। আমরা রামু, সীতাকুণ্ড, মিরসরাইয়ের মতো অঞ্চলে সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করছি। কারণ এসব অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে সাম্প্রদায়িকতা বা সহিংসতার মতো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা মনে করি, প্রকৃত নেতৃত্বের গুণে কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যাবে সমাজ।’
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন সীতাকুণ্ড উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শাহ আলম, ইপসার পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান ও ইপসার প্রকল্প সমন্বয়ক সৈয়দ আশরাফ উল্লাহ।