রাবিতে হলের ফটকে তালা দিলেন ছাত্রলীগ নেতা

হলের গেটে তালা দেওয়া অনাবাসিক শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি শামীম ওসমানের বিছানাপত্র কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়
ছবি : প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেটে তালা দিয়েছেন শামীম ওসমান নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। হলে তাঁর তুলে দেওয়া ছাত্রলীগের এক কর্মীকে হল প্রাধ্যক্ষ বের করে দেওয়ায় তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শামীম ওসমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং ফলিত গণিত বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটান তিনি।

হলের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলামের আসন বরাদ্দ ছিল ২৪৪ নম্বর কক্ষে। কিন্তু ওই কক্ষ ছাত্রলীগের দখলে থাকায় হল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ৪৩০ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। ঈদের পর দুই শয্যার ওই কক্ষে অনাবাসিক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কর্মী শফিউল্লাহকে তোলেন শামীম ওসমান। সম্প্রতি কক্ষটিতে রায়হান নামের আরেক শিক্ষার্থীকে শয্যা বরাদ্দ দেন প্রাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। এরপর গত মঙ্গলবার রাকিবুলকে ২৪৪ নম্বর কক্ষে আনা হয়। কিন্তু ওই কক্ষ তখনো ছাত্রলীগের দখলে থাকায় সেখানে রাকিবুলকে তুলতে না পেরে আবার ৪৩০ নম্বর কক্ষে আনা হয়। একই সঙ্গে শফিউল্লাহর সঙ্গে রাকিবুলকে শয্যা–ভাগাভাগি করে থাকতে বলেন প্রাধ্যক্ষ। কিন্তু রাকিবুলের বিছানাপত্র কক্ষের বাইরে ফেলে দেন শফিউল্লাহ। পরে বৃহস্পতিবার সকালে শফিউল্লাহর বিছানাপত্র অফিসকক্ষে নিয়ে আসেন প্রাধ্যক্ষ।

খবর পেয়ে ছাত্রলীগ নেতা শামীম ওসমান দুপুরে হল গেটে দুই দফা তালা দেন। বেলা আড়াইটার দিকে এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা থাকায় তিনি তালা ভেঙে বের হন। এরপর শামীম আবার এসে তালা দেন। পরে হল প্রশাসন এসে তালা খোলে। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা জড়ো হন। পরে এ বিষয়ে বেলা সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হল প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক, হলের ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মো. শরিফুল ইসলাম, ওই হলের আবাসিক শিক্ষক তানজিল ভূঞা, মামুনূর রশীদ সরকার, মো. ফারুক হোসেন, ড. অনুপম হীরা মণ্ডলসহ সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সহসভাপতি শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, শফিউল্লাহকে তিনি তুলেছিলেন। এটা হল প্রশাসন জানত। কিন্তু তাঁকে আবাসিক করা হয়নি। শফিউল্লাহকে না জানিয়ে প্রাধ্যক্ষ তাঁর বিছানাপত্র নিয়ে আসেন। পরে তিনি হল গেটে তালা দেন।

শামীম ওসমান নিজে ওই হলের আবাসিক ছাত্র কি না জানতে চাইলে বলেন, তাঁর আবেদন করা আছে। কিন্তু হলের আবাসিক কার্ড নেওয়া হয়নি।

বৈঠকে থাকা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, শামীমের কাছে গেটে তালা দেওয়ার কারণ জানতে চান হল প্রাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। একপর্যায়ে শামীমের হলে থাকার আবাসিক কার্ড আনতে বলেন। এ সময় তিনি কার্ড দেখাতে পারেননি। পরে জানা যায়, হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নন শামীম। এরপর প্রাধ্যক্ষ বলেন, শামীম অপরাধ করেছেন। তাঁকে হল থেকে বের করে দেওয়া হবে। এ সময় হল শাখা ছাত্রলীগের ১ নম্বর সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শাকিল বলেন, ‘শামীম আমার কর্মী। তাঁকে বের করে দিলে হলের অন্য অনাবাসিক শিক্ষার্থীদেরও বের করে দিতে হবে। না হলে হল থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া যাবে না।’

এ সময় প্রাধ্যক্ষ রেগে গিয়ে বলেন, ‘কে হলে উঠবে—সে সিদ্ধান্ত তোমরাই নিচ্ছ! ঈদের পর ৬৮ জন শিক্ষার্থীকে হলের আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা নয়জনের বেশি সাধারণ শিক্ষার্থীও তুলতে পারিনি। এই চেয়ারে থাকা লজ্জার। এভাবে থাকব না চেয়ারে। এখনই পদত্যাগ করব।’

একপর্যায়ে প্রাধ্যক্ষ বলেন, অপরাধ স্বীকার করে লিখিত দিতে হবে শামীমকে। না হলে এখনই তাঁকে বের করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে। পরে শামীম অপরাধ স্বীকার করে লিখিত দিতে রাজি হন। কিছুক্ষণ পর তিনি যা লিখে আনেন, সেটি দেখে অপরাধ স্বীকার করা হয়নি উল্লেখ করে প্রাধ্যক্ষ তা গ্রহণ করেননি। পরে শামীমকে আবার লিখিত নিয়ে আসতে বললে তিনি হল থেকে চলে যান। এ সময় প্রাধ্যক্ষ শামীমের বিছানাপত্র হল থেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী বিছানাপত্র নিয়ে আসা হয়।

জানতে চাইলে হল প্রাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শামীম রমজান মাসের দ্বিতীয় দিন হলের পাঁচটি প্লেট ভেঙেছিলেন। নিজে অনাবাসিক ছাত্র হয়েও অন্য আরেক অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে হলে তুলেছেন। এটা এমনিতেই অন্যায়। কিন্তু ওই অনাবাসিক শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নিয়ে আসায় শামীম হলের গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কাছে লিখিত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শামীম সবার মধ্যে থেকে লিখিত না দিয়ে চলে গেছেন।

আরও পড়ুন

আলোচনা সভা থেকে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে শামীম ওসমান বলেন, তিনি লিখিত দিয়েছেন তাঁর মতো করে। প্রাধ্যক্ষের মতো করে মনগড়া লিখিত দেবেন না। তাই চলে এসেছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। বিষয়টি তিনিই সমাধান করবেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে সহকারী প্রক্টর মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, তিনি সবকিছু শুনেছেন। এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।

প্রসঙ্গত, করোনার পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলার পর ছাত্রলীগ শুরুতে আসন দখল করতে আবাসিক হলে তালা মারতে শুরু করে। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫৬ ও ৪৭৬ নম্বর কক্ষ থেকে দুজনকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। ৮ ডিসেম্বর রাতে এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাদার বখ্শ হলের ১৫৩ নম্বর কক্ষ থেকে এক শিক্ষার্থীকে, ১২ এপ্রিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হল থেকে একজনকে, ১৭ মে শহীদ হবিবুর রহমান হল থেকে একজনকে, একই হল থেকে গত ২৮ মে এক শিক্ষার্থী এবং ২ জুন রাতে শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হল থেকে আরেক শিক্ষার্থীকে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা।