হঠাৎ কালচে নদীর পানি
নওগাঁ শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট যমুনা নদী। হঠাৎ ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে এই নদীর পানি। কিছুদিন আগেই এ নদীর পানি স্বচ্ছ ছিল, তা এখন কালচে রং ধারণ করেছে। দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে।
নদীদূষণের কারণে প্রশাসনের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও বাসিন্দারা। স্থানীয় ব্যক্তিদের ধারণা, পাশের জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্য তুলসীগঙ্গা নদী হয়ে ছোট যমুনার পানিতে মেশায় এবং নওগাঁ শহর ও আশপাশের এলাকার পোলট্রি ফার্ম, চালকলসহ বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্যের কারণে ছোট যমুনা দূষিত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীতে পানি কম থাকলেও ১০-১২ দিন আগে এ পানি স্বচ্ছ ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে উজান থেকে কালচে পানির প্রবাহ আসতে শুরু করে। এতে নওগাঁ সদর উপজেলার ত্রিমোহনী (ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থল) থেকে আত্রাই উপজেলার ত্রিমোহনী (ছোট যমুনা নদী ও আত্রাই নদের সঙ্গমস্থল) পর্যন্ত ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকার পানি কালো হয়ে যায়। একই সঙ্গে এর প্রভাবে নদীতে ভেসে উঠতে থাকে মরা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর পাড়ে বসবাসরত কয়েক হাজার মানুষের পানির ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট যমুনার পানি দূষিত হওয়ার প্রধান কারণ জয়পুহাট চিনিকলের বর্জ্য। চিনি উৎপাদন মৌসুমে জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্য তাদের নিজস্ব খালে (লেগুন) ফেলা হয়। এই খালে জমানো চিনিকলের তরল বর্জ্য প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তুলসীগঙ্গা নদীতে ছাড়া হয়। তুলসীগঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হয়ে এসব বিষাক্ত বর্জ্য নওগাঁ সদর উপজেলার ছিটকিতলা-ত্রিমোহনী এলাকায় ছোট যমুনার পানিতে এসে মিলিত হয়। এ ছাড়া জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ ও নওগাঁর বদলগাছি এলাকায় কয়েক শ মুরগির খামার রয়েছে। এসব খামারের বর্জ্য ও মরা মুরগি বস্তায় করে তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনায় ফেলা হয়। নদীর তীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা চালকলের তরল বর্জ্য ও ছাই হরহামেশাই ফেলা হচ্ছে ছোট যমুনায়। এসব কারণে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে নদীর পানি।
নওগাঁ শহরের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কিছুদিন আগেও নদীর পানি স্বচ্ছ ছিল। এলাকার ছেলেমেয়েরা নদীর পানিতে দল বেঁধে সাঁতার কেটে গোসল করত; কিন্তু হঠাৎ নদীর পানি কালচে হয়ে যাওয়ায় এই পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়। এ কারণে কেউ আর নদীতে গোসল করতে আসছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নওগাঁ শাখার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ছোট যমুনার পানি দূষিত হওয়ার জন্য শুধু চিনিকল নয়, ছোটখাটো অনেক কলকারখানা রয়েছে, যেগুলো থেকে দূষিত বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টি হয়। বিভিন্ন খাল ও মাঠে জমে থাকা এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে ছোট যমুনার পানিতে মিশে পানি ব্যাপক হারে দূষিত হয়। এ ছাড়া নওগাঁ শহরের কোমাইগাড়ী এলাকার ছোট যমুনার নদীর পশ্চিম তীর রক্ষা বাঁধের রাস্তার পাশেই খোলা স্থানে পৌরসভার সব বর্জ্য ফেলা হয়। বৃষ্টি পানির কারণে এসব বর্জ্যও ছোট যমুনার পানিতে মিশেছে। এসব নানা কারণে প্রতিনিয়ত ছোট যমুনা নদী দূষিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত রাখতে সবাইকেই সচেতন হতে হবে।
ভারপ্রাপ্ত জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘আমি নিজে সরেজমিন দেখেছি, ছোট যমুনার পানি কালচে হয়ে গেছে। নদীর পানি কী কারণে দূষিত হচ্ছে, এর কারণ খোঁজার জন্য নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা হবে। ল্যাবরেটরিতে পানি পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই কোন ধরনের রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে পানি দূষিত হচ্ছে, তা জানা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার কারণে পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পারিমাণ কমে যায়। এতে ধীরে ধীরে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী টিকে থাকার সামগ্রিক পরিবেশ হারায়।
জানা গেছে, জয়পুরহাট শহরে ১৯৬৩ সালে দেশের বৃহত্তম চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই চিনিকলে তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করা হয়নি। চিনিকলের বর্জ্য নিজস্ব খালে ফেলা হয়। ওই খালের পানি আবার আশপাশের খালে গিয়ে পড়ে। এসব খালের পানি প্রবাহিত হয়ে তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনার পানির সঙ্গে মিশে যায়। তখন নদীর পানিতে ব্যাপক দূষণ দেখা দেয় এবং নদীর মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মরে ভেসে ওঠে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জয়পুরহাট চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খুরশিদ জাহান মাফরুহা দাবি করেন, ‘চিনিকলের বর্জ্য ফেলার জন্য ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি নিজস্ব লেগুন (খাল) রয়েছে। এক মাস আগে থেকে চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালটি এখন শুকনো হয়ে রয়েছে। চিনিকলের বর্জ্য তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনায় পানিতে ফেলার যে কথা বলা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। আমরা সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছি, নদীর পানি দূষিত হওয়ার পেছনে চিনিকলের কোনো ভূমিকা নেই; বরং বিভিন্ন পোলট্রি ফার্মের বর্জ্য নদীতে ফেলায় এবং নদীর পাড়ে জমানো ময়লার ভাগাড় থেকে বর্জ্য নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে।’