সোনালি আঁশে বিবর্ণ জীবন
পাটের কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। চাকরিজীবনের সায়াহ্নে এসে ভাবতে পারেননি এভাবে অনশনে নামতে হবে। আন্দোলনে গিয়ে জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে, তা ভাবতে পারেনি তাঁর পরিবারও।
মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে ১০ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি চলাকালে পাটকলশ্রমিক আবদুস ছত্তার প্যাদা গত বৃহস্পতিবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর সদর উপজেলার বড়বিঘাই ইউনিয়নের তিতকাটা গ্রামে।
সম্পত্তি বলতে শুধু ১৫ শতাংশের একখণ্ড জমির ওপর একটি ছোট্ট ঘর। ১৯৮৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাড়িঘর ফেলে খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে চাকরি নেন ছত্তার প্যাদা। পরে বিয়ে করে সংসার পাতেন। তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে ইমরান এ বছর এসএসসি পাস করেছে। ছোট ছেলে হুমায়ুন মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ছে। বাড়িতে ভিটাটুকু ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে আবদুস ছত্তার প্যাদার বাড়ি তিতকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িভর্তি লোকজন। ছোট ছেলে ইমরান মাকে বুকে জড়িয়ে শুধু কাঁদছে। বড় ছেলে ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশে আসছে। সবাই তার অপেক্ষায় রয়েছেন।
এলাকার লোকজন জানান, আবদুস ছত্তার ১১ মাস ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না। বেতনের আশায় খুলনা ছিলেন তিনি। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে পরিবারটি। এলাকাবাসী জানতেন আবদুস ছত্তার সাত মাস পরই অবসরে যাবেন। তাই বকেয়া টাকা তুলতেই খুলনায় ছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রওশনারা বেগম বলেন, এলাকার লোকজনের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বাজারের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। সেই টাকায় তাঁদের ভরণপোষণ, সন্তানদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য খরচ চলছিল। স্বামী বেতন পেলে টাকা পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন। তবে বেতনের টাকা নিয়ে আর আসবেন না তাঁর স্বামী—এই বলে কেঁদে ফেলেন রওশনারা বেগম।
গতকাল বিকেলে বড় ছেলে ইমরান ঢাকা থেকে বাড়িতে পৌঁছালে বাড়িজুড়ে কান্নার রোল পড়ে। পরিবারের সদস্যদের কান্নায় অন্যদের চোখও সিক্ত হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলে ইমরান বলে, ‘বাবা বেতন পাচ্ছিলেন না। মা ঋণ করেছেন, কিস্তি দিতে হবে। তাই কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়েছিলাম।’
সন্ধ্যার পর ছত্তার প্যাদার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। গ্রামে শত শত মানুষ তাঁকে একনজর দেখতে ভিড় করেন। এরপর বাড়ির পাশে মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।