বন্যা–নদীভাঙনে দিশেহারা চার চরের মানুষ
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরলা নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। নদীভাঙনে সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চারটি চরের দেড় শ পরিবারের বসতভিটা এক সপ্তাহে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মাধ গ্রাম থেকে বারাইবাড়ী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকার ২০টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। জগমোহন, নানকা, নন্দদুলাল ও বরাইবাড়ী চরের দেড় শ পরিবার নদীভাঙনের কারণে বসতভিটা হারিয়েছে।
ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, পাঁচ দফা বন্যা, নদীভাঙন ও টানা বৃষ্টিতে তাঁর ইউনিয়নের ধরলা তীরের মানুষের অবস্থা কাহিল। মাধ গ্রাম থেকে বারাইবাড়ী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকার ২০টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। জগমোহন, নানকা, নন্দদুলাল ও বরাইবাড়ী চরের দেড় শ পরিবার নদীভাঙনের কারণে বসতভিটা হারিয়েছে। জগমোহনের চরে কোনো বসতি নেই। এ ছাড়া খেতের সব ফসল প্রায় শেষ। নন্দদুলালেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনশেড ভবন নদীতে চলে গেছে। সবকিছু পরিষদে এনে রেখেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নৌকায় জগমোহন চরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের চাল, বেড়া, মালামাল ও ভাঙা গাছপালা পড়ে আছে। কোনো বসতি নেই। পশ্চিম পাশে ধরলা নদীর পানি প্রচণ্ড বেগে চরের পাড়ে আঘাত করছে। কয়েক মাইলজুড়ে ভাঙন চলছে। আশপাশের সব গ্রাম ও বাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এ সময় কথা হয় জগমোহন চরের বাসিন্দা ফালানী বেওয়ার সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধরলা হামাক শ্যাষ করিল। স্বামী মরিল বানোত (বন্যায়)। এলা ভিটাবাড়ি নদীত গেইল। ছাওয়া পাওয়াক নিয়া মসজিদের কোনাত উঠছি। জীবনে এমন ঝড়ি (বৃষ্টি), বান (বন্যা), নদীভাঙন দেখো নাই।’
ধরলা হামাক শ্যাষ করিল। স্বামী মরিল বানোত (বন্যায়)। এলা ভিটাবাড়ি নদীত গেইল। ছাওয়া পাওয়াক নিয়া মসজিদের কোনাত উঠছি। জীবনে এমন ঝড়ি (বৃষ্টি), বান (বন্যা), নদীভাঙন দেখো নাই
পাশেই রশি তৈরি করছিলেন ফালানী বেওয়ার মেয়ে আফতাফুন ও চাচা গোলজার হোসেন। গোলজার বললেন, ‘চরে ৪৫টা বাড়ি আছিল। সবাই কামলা দিয়া চলে। গরিব মানুষ। এল্যা একটাও নাই। সপ্তাহখানেক আগে বন্যার পানির রাতে চরের ঘরবাড়ি ভাসে নিয়া যায়। মানুষ ঘর সরাম সে সময় নাই। আশপাশের মানুষ আসি ঘরগুলো রক্ষা করে।’ পাশেই ঘরের চাল নৌকায় তুলছিলেন মোজাম্মেল হোসেন। তিন বলেন, ‘ঘর নিয়া সড়কোত যাম। হাতে টাকা নাই। তাই একজনের কাছে ২০০ টাকা হাওলাদ করি নৌকায় ঘর সরাচ্ছি।’
জগমোহনচর থেকে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অনেকগুলো ঘরের চাল, চকি, আসবাব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। এ সময় নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কেরামত আলী বলেন, ‘নিজের জায়গা নাই। বাধ্য হয়া সড়কোত ঘর থুইছি। পরিবার নিয়া বাজারের পাশে মোজাম্মেলের বাড়ির কানচাত (এক কোনায়) উঠছি।’
ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, ‘বাজারের পাশে ধরলা নদীতে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হওয়ায় কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়ক হুমকির মুখে পড়েছে। ২০১৭ সালের বন্যায় আমার ইউনিয়নে সড়কের ৪টি স্থান ভেঙে বড় খাদের সৃষ্টি হয়েছিল। সড়ক ও জনপথ বিভাগ পরে সড়ক সংস্কার করে দিয়েছিল।’
উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা খন্দকার মো. ফিজানুর রহমান বলেন, পাঁচ দফা বন্যায় ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নে সব মিলিয়ে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের নদীভাঙনকবলিত ১০৫টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।
ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনে প্রতিমন্ত্রী
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শুক্রবার বিকেল ৫টায় সদর উপজেলার ধরলার ভাঙনকবলিত মোগলবাসা এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি নদীভাঙনে ঘরহারা মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। এ সময় জাহিদ ফারুক বলেন, ‘বন্যার পানির কারণে নদীভাঙনসহ যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা কমানোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নদী ড্রেজিংয়ের বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এসব বাস্তবায়ন করতে পারলে বন্যা ও নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি কমে যাবে।’
মোগলবাসা এলাকা পরিদর্শনের সময় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুল ইসলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক এ এম আমিনুল হক, স্থানীয় সাংসদ পনির উদ্দিন আহমেদ, আসলাম হোসেন সওদাগর, পাউবোর উত্তারাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ, রংপুর পওর সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুস শহীদ, জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম, পাউবোর কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।