নাসরিন বানুর প্রসবব্যথা উঠেছে। তিনি আছেন একটি কক্ষে। বারান্দায় পায়চারি করছেন তাঁর দিনমজুর স্বামী আতাউর রহমান। একসময় অপেক্ষার পালা শেষ হলো। নবজাতকের কান্নার শব্দ ভেসে এল তাঁর কানে। একটু পর নবজাতককে নিয়ে বের হয়ে আসেন একজন নারী। শিশুর মুখ দেখে চোখে আনন্দের ঝিলিক আতাউরের।
আতাউর রহমানের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে। তিনি জানান, রাজশাহীতে কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, স্বাভাবিক প্রসবে ন্যূনতম খরচ হবে ৮ হাজার টাকা। আর অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান) হলে দিতে হবে অন্তত ২০ হাজার টাকা। পরে প্রতিবেশীদের পরামর্শে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রেই জন্ম হয় তাঁদের ছেলেশিশুর।
আতাউর ও নাসরিন দম্পতির মতো অনেক অসহায় মানুষের সহায় তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র। এখানে ২৪ ঘণ্টাই প্রসূতিরা আসেন নিরাপদে সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিনা খরচে সন্তান জন্মের পর হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা।
প্রসূতিসেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় এই কেন্দ্র গত বছর সারা দেশে শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পুরস্কার পেয়েছে। এর আগে আরও আটবার দেশসেরা হয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল—এই নয়বার এই দেশসেরার মর্যাদা অর্জন পায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটি। মাঝে ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১১ সালে এটি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মর্যাদা পায়।
আতাউর-নাসরিন দম্পতির নবজাতক কোলে নিয়ে প্রসূতিকক্ষ থেকে বের হয়েছিলেন যে নারী, তিনি কেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) নাহিদ সুলতানা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে তাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রসূতিসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় কেন্দ্রটির সঙ্গে তিনিও নয়বার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার পুরস্কার পান।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সূত্রে জানা গেছে, মার্চ মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ৭৫ জন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ফেব্রিয়ারি মাসে ১১২ জন এবং জানুয়ারি মাসে ১১৮ জন প্রসূতি এখানে সন্তান জন্ম দেন। গত বছর ১ হাজার ৭১৬ জন প্রসূতি এই কেন্দ্রে এসে সন্তান জন্ম দেন। ২০০৮ থেকে ২০১৮—এই ১০ বছরে এই সংখ্যা বেশ বড়; ১৭ হাজার ৪৫৭।
এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন প্রসূতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দেন। গত ২০ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ বেশ পরিচ্ছন্ন। কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, একটি বড় কক্ষে ২০-২২ জন নারী বসে আছেন। কয়েকজন পুরুষও রয়েছেন সেখানে। সেবা নিতে আসা নারীদের কাছে সেখানকার সেবার মান কেমন, তা জানতে চাইলে প্রায় সবাই পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা ও আয়া আনোয়ারা বেগমের প্রশংসা করেন। জামেলা বেগম নামের এক নারী উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, ‘সুলতানা ও আনোয়ারা আপার হাতযশ ভালো। গর্ভবতী মায়েরা এখানে এলে আর কোনো ভয় থাকে না।’
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভেতরে আরেকটি কক্ষে দেখা গেল, পাশাপাশি দুটো শয্যায় দুজন নারী। তাঁদের পাশেই সদ্যোজাত দুটি শিশুকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা। জানা গেল, দুটি শিশুই ওই দিন সকালে জন্ম নিয়েছে। সেবা নিতে আসা রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার শিহালয় গ্রামের কুরবান আলী বলেন, এখানকার সেবার মান খুবই ভালো। তাঁদের প্রথম সন্তানও এখানে হয়েছে।
এখানেই কথা হয় রাজশাহীর তানোর উপজেলার আতাউর রহমানের সঙ্গে। নতুন তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে নবজাতককে নিয়ে হাসিমুখে কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা। আতাউরের উদ্দেশে বলেন, ফুটফুটে ছেলেসন্তান হয়েছে।
ওই মুহূর্তের অনুভূতি জানতে চাইলে নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। গর্ভের সন্তান সুস্থভাবে পৃথিবীতে এলে মা যেমন সব কষ্ট ভুলে যান, তেমনি আমিও প্রশান্তি অনুভব করি।’
তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা বলেন, ‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে সেবা পাওয়া যায়, টাকা দিয়েও অনেক ক্লিনিক-হাসপাতালে তা পাওয়া যায় না। এখানকার সুখ্যাতির জন্য মান্দা উপজেলার অন্য ইউনিয়নের মানুষ, পাশের নিয়ামতপুর উপজেলা, রাজশাহীর তানোর, মোহনপুর ও বাগমারা উপজেলা থেকে লোকজন এখানে আসেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের একদম কাছেই। এ কারণে প্রসূতিরা সহজেই এখানে আসতে পারেন। আবার কোনো প্রসূতির সন্তান প্রসবে জটিলতা দেখা দিলে এখান থেকে দ্রুতই তাঁদের রাজশাহীতে নেওয়া সম্ভব হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতি ও নবজাতকদের থাকার জন্য একটি ওয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হবে। শিগগির এই কাজ শুরু হবে। গত বছর শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শক শফিকুর রহমান বলেন, ‘পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা নাহিদ সুলতানা ও তাঁর স্বামী ওই কেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (স্যাকমো) মোজাম্মেল হক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করেন। ফলে এই এলাকার প্রসূতি ও অন্য রোগীরা সার্বক্ষণিক তাঁদের এখানে পান।
স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় পর্যায়ে নয়বার শ্রেষ্ঠ উপসহকারী কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হন এই মোজাম্মেল হক। আর ২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক হন শফিকুর রহমান।
নাহিদ সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সালে পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে নিয়ামতপুরের একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে যোগ দিই। ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে আছি। এই চাকরিজীবনে আমার হাতে প্রায় ২০ হাজারের বেশি শিশুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে। আমার হাত ধরে এতগুলো শিশু পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে, মাঝেমধ্যে এটা মনে করে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি আমার কাজকে কখনোই চাকরি মনে করি না। এটা আমার দায়িত্ব। যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, যখন শুনি কোনো রোগী জটিলতা নিয়ে এসেছে, তখন আর ঘরে থাকতে পারি না।’
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী পরিচালক ও ডিস্ট্রিক্ট কনসালট্যান্ট কামরুল আহসান বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির সাফল্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। প্রতি মাসে ১২০ থেকে ১৩০ জন প্রসূতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করানো সহজ কথা নয়। আমরা যখন অন্য কেন্দ্রে যাই তখন তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরি।’
এ ব্যাপারে জেলা পরিবার ও পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক কুস্তরী আমিনা বলেন, তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটি নওগাঁ ও রাজশাহীর সীমান্তবর্তী। ওইখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনেক দূরে। ফলে ওই এলাকার মানুষ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেখানে কর্মরত স্বাস্থ্য পরিদর্শক, পরিদর্শিকা ও উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মানুষের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছেন।