পুরোনো রূপেই পুরান ঢাকা

রাজধানীর শ্যামপুর বাজার এলাকায় উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকায় অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। গত ২৮ আগস্ট দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর শ্যামপুর বাজার এলাকায় উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকায় অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। গত ২৮ আগস্ট দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাড়ে পাঁচ মাস পরও রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু করা যায়নি। এসব গুদাম অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নিতে যে দুটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে, এর একটিতে এখনো প্রায় ৪৫০টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে, অন্যটিতে রয়েছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। ফলে আগের মতোই ঝুঁকি নিয়ে রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে পুরান ঢাকায়। আবার পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকের ঝুঁকিমুক্ত করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে।

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের পর সেখান থেকে দ্রুততম সময়ে রাসায়নিক গুদামগুলো অস্থায়ী ভিত্তিতে সরিয়ে নিতে দুটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়। একটি গাজীপুরের টঙ্গীতে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) ছয় একর জমি, অন্যটি ঢাকার শ্যামপুরে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, সেখানেও জমির পরিমাণ ছয় একরের কিছু বেশি।

দুই প্রকল্পে মোট ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কাজ দ্রুত করতে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের বদলে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে। তবে দুই প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে অনুমোদন কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এখন অর্থ বরাদ্দের অপেক্ষা ও ঠিকাদার নিয়োগের পালা। প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ।

তবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন বলেন, অস্থায়ী গুদামে যাওয়ার জন্য চুক্তির বিষয়ে কেউ তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। গুদামের ভাড়া কত হবে, কী শর্তে ব্যবসায়ীরা সেখানে যাবেন, এসব বিষয় এখনো অজানা। তিনি বলেন, ‘দেখবেন, আরেকটি দুর্ঘটনার পর সবাই নড়েচড়ে বসবে।’

অবশ্য চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের আগে ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নিতে রাসায়নিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প চূড়ান্ত করতেই লেগে যায় আট বছর। আবার চুড়িহাট্টার আগুনের পর রাসায়নিক শিল্পনগর প্রকল্পের জমির পরিমাণ ৫০ একর থেকে বাড়িয়ে ৩১০ একর করা হয়। এই প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার তিনটি মৌজায় জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য স্থানীয় জেলা প্রশাসনে পাঠানো। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

>

টঙ্গী ও শ্যামপুরে গুদামের কাজ শুরু হয়নি
জমিতে অবৈধ দখল
পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করার কার্যক্রমেও ভাটা

শিল্পনগর যদি ২০২২ সালে হয়ে যায়, তাহলে মাত্র দেড় বছর অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য ১৬৮ কোটি টাকা খরচের প্রয়োজন আছে কি না, জানতে চাইলে শিল্পসচিব মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘শিল্পনগর তৈরি করতে আমাদের ২০২২ সাল পর্যন্ত লাগবে। জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর ব্যবসায়ীরা সেখানে অবকাঠামো তৈরি করবেন। এতে সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, অস্থায়ী গুদাম তৈরিতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নথিগত কাজ শেষ করা হয়েছে। এখন সংস্থা পর্যায়ে কাজ হবে।

টঙ্গীতে ‘অবৈধ’ বসতি

টঙ্গীতে বিএসইসির জমিটি কাঁঠালদিয়া মৌজায়। সেখানে ৫৩টি রাসায়নিক গুদাম নির্মাণের কথা। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত ২৮ আগস্ট কাঁঠালদিয়া মৌজায় গিয়ে দেখা যায়, রাসায়নিক গুদামের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি এখনো বেদখল। সেখানে প্রায় ৪৫০টি পরিবার বাস করে। অনেকে দোকান করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন। রয়েছে গুদামঘরসহ ছোট ছোট কারখানাও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাঁচ-ছয় মাস আগে কয়েক ব্যক্তি এসে জমিটি মাপজোখ করেন, ছবি তোলেন। এরপর আর কেউ আসেনি।

উজালায় ট্রাকস্ট্যান্ড

শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সেখানে ৬ দশমিক ১৭ একর জমিতে ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

গত ২৮ আগস্ট সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার প্রবেশফটকের পাশ ভেঙে সেখান দিয়ে ট্রাক চলাচলের রাস্তা করা হয়েছে। কয়েক শ ট্রাক রেখে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। অবৈধ দোকানপাট ছাড়াও সেখানে ইটের খোয়া ও বালু রেখে ব্যবসা চলছে।

উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, চুড়িহাট্টার ঘটনার পর এখান থেকে কিছু অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়। মাটি পরীক্ষা করা হয়। পরে আর কোনো কাজ হয়নি।

পুরান ঢাকায় পুরোনো রূপ

২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় আগুনের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম অপসারণে টানা অভিযান চালিয়েছিল বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে রাসায়নিক গুদাম অপসারণে নির্দেশনা ছিল টাস্কফোর্সের। কিন্তু ১০ মার্চ পর্যন্ত অভিযান চললেও পরে তা থেমে যায়।

টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা জাহিদ হাসানের দাবি, চুড়িহাট্টার ঘটনার পর তাঁরা অভিযান চালিয়ে রাসায়নিক গুদাম অপসারণ করেছেন। এখন তাদের পুনর্বাসনসহ অন্যান্য দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের।

গত ৪ মার্চ ইমামগঞ্জের ৫৪/৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের নিচতলায় রাসায়নিক গুদাম সিলগালা করেছিল টাস্কফোর্স। গত ২৮ আগস্ট সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রি করতে দেখা যায়। গুদামের মালিক মো. ওবাদুলের দাবি, তাঁর বিক্রয়নিষিদ্ধ ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই। তবে কী ধরনের রাসায়নিক আছে, তার তালিকা দেখাতে তিনি অপারগতা জানান।

অনেকে গোপনে বিক্রয়নিষিদ্ধ রাসায়নিক বিক্রি করছেন বলে স্বীকারও করেছেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল জলিল। তিনি বলেন, ‘তাঁদের সতর্ক করা হলেও তাঁরা তা মানছেন না। ঢাকার বাইরে রাসায়নিক পল্লির জন্য বহুবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা সহযোগিতা করেনি।’

জয়নাগ রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির লামিয়া এন্টারপ্রাইজে গত ১৮ মার্চ অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। তখন প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২৮ আগস্ট সেখানে রাসায়নিক বিক্রি করতে দেখা যায়।

পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকমুক্ত করার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কাজ সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকতে হয়। রানা প্লাজার ঘটনার পর সেটি অগ্রাধিকারে ছিল বলেই পোশাক খাতে বেশ কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, রাসায়নিক সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকারে থাকে না। সরকার যদি মনে করে, এখন আর উপায় নেই, তখনই কাজ হবে।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ ও আল-আমিন, গাজীপুর)