পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সংকটাপন্ন রক্তিমের সুস্থতার জন্য মায়ের আকুতি
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালের পাশের গ্রাম হাসিনাপাড়া। এই পাড়ায় বন বিভাগের পরিত্যক্ত ভূমিতে ৩৪টি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু পরিবারের বসবাস। গ্রামের মধ্যভাগে অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুরেশ চন্দ্রের টিনের আধা পাকা বসতবাড়ি। আজ শুক্রবার সকাল থেকে সুরেশের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন–প্রতিবেশীর জটলা। বাড়ির উঠানে চলছে নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।
নিহত ব্যক্তিদের বাবা সুরেশেরও মৃত্যু হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে পাঁচ সন্তানের মৃত্যুর ১০ দিন আগে, অর্থাৎ গত ৩০ জানুয়ারি। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে ৯ ভাইবোনের মধ্যে ৫ ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। আরেক ভাই পড়ে আছেন চট্টগ্রাম মহানগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। আরেকজন চিকিৎসাধীন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর তাঁদের এক বোন হিরা সুশীল (৪৫) চিকিৎসাধীন চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে।
১০ দিনের ব্যবধানে পাঁচ ছেলে ও স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক সুরেশের স্ত্রী মানু রানী সুশীল। শোকের বোঝা সামলে তাঁকেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখভাল করতে হচ্ছে।
বেলা ১১টায় মানু রানীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, উঠানে টানানো শামিয়ানার নিচে পূজামণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে এক পাশে টাঙানো নিহত পাঁচ সন্তানের ছবি, ছবির ওপর পরানো ফুলের মালা। পুরোহিত পাশে বসে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা চালাচ্ছেন। মানু রানী নিহত পাঁচ সন্তানের স্ত্রীদের পূজার স্থলে নিয়ে আসেন। সবার পরনে সাদা শাড়ি।
মণ্ডপের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন নিহত অনুপম সুশীলের স্ত্রী পপি সুশীল (৩৫)। পাশে মেয়ে দেবত্রী সুশীল (১৫)। পপি বলেন, স্বামীর অবর্তমানে দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে তিনি কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে, ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে। তাঁর স্বামী ছিলেন পল্লিচিকিৎসক। চট্টগ্রামের আজিজনগর বাজারে তিনি রোগী দেখে সংসার চালাতেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। এখন তিনি নেই, ছেলে–মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালানোর মতো কোনো সম্বলও তাঁর নেই।
একই কথা বলেন নিহত দীপক সুশীলের স্ত্রী পূজা সুশীল (২৬) । তাঁর সংসারে একমাত্র ছেলে আয়ূশ সুশীল (৬)। পূজা বলেন, তাঁর স্বামী দীপক সুশীল কাতারপ্রবাসী ছিলেন। সেখানে তাঁর (দীপক) একাধিক দোকান ছিল। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে পিকআপের চাপায় মারা গেলেন তিনি। এখন কাতারের দোকানের খবর নেওয়ার লোক নেই। তাঁর হাতে স্বামীর রেখে যাওয়া কিছুই নেই।
পূজার স্থলের আরেক পাশে চলছে রান্নাবান্নার কাজ। দুপুর থেকে সেখানে লোকজনকে খাওয়ানো হচ্ছে। সবকিছু সামাল দিচ্ছেন মানু রানী।
৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মানু রানীর পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯) নিহত হন। আহত হন আরও তিন ভাই–বোন। ঘটনার ১০ দিন আগে তাঁদের বাবা সুরেশের মৃত্যু হয়। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা ৯ ভাইবোন বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানকার একটি মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে ৯ ভাইবোন (৭ ভাই ও ২ বোন) পায়ে হেঁটে বাড়িতে আসার জন্য সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এ সময় পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই একসঙ্গে চারজনের মৃত্যু হয়, বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরেক ভাই। ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান সুরেশ চন্দ্রের মেয়ে মুন্নী সুশীল। তিনি বলেন, ঘটনার চার দিন পার হলেও পুলিশ এখনো পিকআপচালককে আটক করতে পারেনি। চালক ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের চাপা দিয়েছেন। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠান তদারকি করছিলেন মুন্নী সুশীলের স্বামী খগেশপ্রতি চন্দ্র। তিনি বলেন, নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দুপুরে শেষ হলে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। অন্তত এক হাজার মানুষকে খাওয়ানো হবে, রকমারি সবজির সঙ্গে সাদা ভাতের নিরামিষ খাবার।
খগেশপ্রতি জানালেন, চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁদের ভাই রক্তিম সুশীলের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁকে বাঁচানো যাবে কি না, সন্দেহ। গত বুধবার রাতে সেখানকার আইসিইউতে ৭২ ঘণ্টা পার হয়েছে, কিন্তু এখনো তাঁর নড়াচড়া নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্লাবন সুশীলের অবস্থাও অপরিবর্তিত, উন্নতি হচ্ছে না। বুধবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে হঠাৎ তিনি মাটিতে পড়ে যান। এখনো তিনি কথা বলতে পারছেন না।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে চট্টগ্রামের হাসপাতালের আইসিইউতে সংকটাপন্ন সন্তান রক্তিম সুশীলের সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেন মা মানু রানী। ক্ষণে ক্ষণে বলছিলেন, ‘ভগবান, রক্তিমকে ফিরিয়ে দাও। মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। এ জীবনে আর কত পরীক্ষা নিবা ভগবান।’ এই কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা।
স্বজনেরা জানান, রীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক কারও মৃত্যু হলে ১০ দিন পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়, আর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ৪ দিনের মাথায় করতে হয় এই অনুষ্ঠান।
এই দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলে জানালেন চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শেফায়েত হোসেন। তিনি বলেন, পিকআপ ভ্যান জব্দ করা হয়েছে। ভ্যানের চালক ও মালিককে ধরার চেষ্টা চলছে।