নেদারল্যান্ডস সফরের অভিজ্ঞতায় কুয়াকাটার সৌন্দর্য রক্ষার পরিকল্পনা
২০১৫ সালে পাউবো ‘কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সেই প্রকল্পে ভারতের কেরালায় আরব সাগরের তীরে নির্মাণাধীন সৈকতের আদলে কুয়াকাটায় গ্রিন সি ওয়াল ও জিও টিউবের মাধ্যমে ভাঙন থেকে রক্ষা করে সৈকত উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সৈকতজুড়ে এখন শুধু ভাঙনের খেলা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউ একে একে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্পটগুলো। সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। অব্যাহত ভাঙন থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার পরিকল্পনা নিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রসৈকতের আদলে গড়ে উঠবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। সৈকতের ক্ষয় ও ভাঙন রোধে ব্যবহার করা হবে নেদারল্যান্ডসের টেকসই প্রযুক্তি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কলাপাড়া কার্যালয় সূত্র জানায়, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতকে ভাঙন থেকে রক্ষা করে সৌন্দর্য বাড়াতে দুই বছর আগে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডস সফর করেছেন। সেই সফরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ওই দেশ যেভাবে সমুদ্রসৈকত রক্ষা করছে, যেসব প্রযুক্তি ও পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে, সেসব প্রযুক্তি ও পদক্ষেপ এখানে বাস্তবায়ন করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে এসে সেই অনুযায়ী সমীক্ষা শেষ করেছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি। ঋতুভেদে এ বিশাল সমুদ্রসৈকত ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। শীতের কুয়াকাটা শান্ত আর বর্ষার কুয়াকাটা উত্তাল, উন্মত্ত ও ভয়াবহ। বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কুয়াকাটার রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। কারণ, বিশ্বের একমাত্র এই সমুদ্রসৈকত থেকেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের লোভনীয় মনোরম সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। তাই কুয়াকাটা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণে মুখর থাকে।
নেদারল্যান্ডসের সৈকত ক্ষয় ও ভাঙন রোধে যেসব টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায়ও সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
১৯৯৮ সালে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণার পর থেকে সারা বিশ্বের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কুয়াকাটা। বিনিয়োগকারীরাও ছুটে এসে হোটেল-মোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে কুয়াকাটাকে সৌন্দর্যের নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাগরের অব্যাহত ভাঙনের ফলে কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকত ছোট হয়ে আসছে। আট কিলোমিটার প্রশস্ত সৈকত এখন সংকুচিত হয়ে এমন হয়েছে যে জোয়ারের সময় পর্যটকেরা সৈকতের বেলাভূমিতে নামতে পারছেন না। সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সৈকত লাগোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
এর আগে ২০১৫ সালে পাউবো অব্যাহত ভাঙন থেকে কুয়াকাটার সৈকত রক্ষায় ‘কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সেই প্রকল্পে ভারতের কেরালায় আরব সাগরের তীরে নির্মাণাধীন সৈকতের আদলে কুয়াকাটায় গ্রিন সি ওয়াল ও জিও টিউবের মাধ্যমে ভাঙন থেকে রক্ষা করে সৈকত উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে ভাঙন ঠেকাতে সৈকতের প্রবেশমুখের দুই পাশে ৩৭০ মিটার এলাকায় জিও টিউব দেওয়ার উদ্যোগ নেয় পাউবো।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুয়াকাটা সৈকতের ৩৭০ মিটার এলাকায় জিও টিউব বসানোর কাজ শেষ করে পাউবো। এতে ব্যয় হয়েছিল ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। জিও টিউবগুলো বসানোর পর কিছুদিন ভাঙন বন্ধ হলেও পরে আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। জিও টিউবের ওপর দর্শনার্থীরা বসা ও হাঁটাচলা করার ফলে ছিদ্র ও কাটা পড়ে টিউবের ভেতরের বালু সরে যাওয়ায় এখন আবার সৈকতে ভাঙন শুরু হয়েছে বলে মনে করছে পাউবো।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ আগস্ট থেকে বঙ্গোপসাগরের প্রবল স্রোত ও বেশি উচ্চতার জোয়ারের তাণ্ডবে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের তোড়ে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের ব্যাপক এলাকা ভাঙনকবলিত হয়। ভাঙনের থাবায় সৈকতে যাওয়ার মূল সড়কটির কমপক্ষে ২৫ ফুট সাগরে বিলীন হয়ে যায়। সৈকতের প্রবেশপথের পাশে মসজিদ, মন্দির, ট্যুরিস্ট পুলিশের ছাউনি, পৌরসভার পাবলিক টয়লেট ও পর্যটন পার্ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৈকত লাগোয়া বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছ উপড়ে যায়।
২৯ আগস্ট কুয়াকাটার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম। এ সময় তিনি ভাঙনের কবল থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা জানিয়ে বলেন, নেদারল্যান্ডসের সৈকত ক্ষয় ও ভাঙন রোধে যেসব টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায়ও সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কুয়াকাটা ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। কারণ, এ দুটি সৈকত আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে যেমন দেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিদেশিদের আগমন ও রাজস্ব আয় বাড়বে।
সরকার কুয়াকাটা নিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিলেও সবার আগে প্রয়োজন কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধ। তা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।আবদুল বারেক মোল্লা, কুয়াকাটা পৌর মেয়র
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুমান ইমতিয়াজ বলেন, কুয়াকাটার ভাঙন রোধে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারে কথা বলে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখছেন না তাঁরা। কুয়াকাটা এখন যেভাবে ভাঙছে, তাতে এলাকার লোকজনসহ বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসছে। কুয়াকাটার পৌর মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা বলেন, সরকার কুয়াকাটা নিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিলেও সবার আগে প্রয়োজন কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধ। তা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না, ভাঙনে উন্নয়নও বিলীন হবে।
ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী ভাঙনকবলিত অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে আপত্কালীন জরুরি মেরামত কাজ করা হবে। সৈকতের স্থায়ী সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রসৈকতের আদলে গড়ে উঠবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। কুয়াকাটা সৈকত সুরক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৫৮ কোটি টাকা। খুব দ্রুত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এটি হবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষাসহ উন্নয়নের একটি কার্যকর প্রকল্প।