দুর্গম পথের শেষে খাসিকন্যার হাসি

মায়ের সঙ্গে মার্গ্রেট সুমের (ডানে)
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ৫ নম্বর খাসিপুঞ্জির মেয়ে মার্গ্রেট সুমের। পুঞ্জিতেই খাসি (খাসিয়া) এই তরুণীর জন্ম, বেড়ে ওঠা। পুঞ্জিতে মা-মাসিদের দেখেছেন পানা তোলা, পান গোছানো এসব করতে করতেই জীবন শেষ। কিন্তু শৈশব থেকেই তাঁর পৃথিবীটাকে, দেশটাকে জানার আগ্রহ ছিল। নিজেকে, পরিবার ও সমাজে বদল আনার স্বপ্ন ছিল। সেখান থেকে তাঁর পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। পাহাড়ি গ্রাম থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয় থেকে যে স্বপ্নের শুরু, সেই স্বপ্ন পূরণে এই তরুণী শিক্ষার উচ্চতর স্তরকে স্পর্শ করে সফলভাবে ঢাকার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করছেন। সফল নারী হিসেবে চলতি বছর পেয়েছেন জয়িতা সম্মাননাও।

খাসিকন্যা মার্গ্রেট সুমের তাঁর জনগোষ্ঠীর মেয়েদের জন্য বটেই, অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের জন্যও এক অনুপ্রেরণার নাম। দুর্গম পথ পেরিয়ে সফলতায় যাত্রার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর পুঞ্জির মিশনারি স্কুলে। সেই যে বইয়ের সঙ্গে সংযোগ প্রথম, এরপর সারা জীবন বইয়ের ঘ্রাণ, অক্ষর নেশার মতো তাঁকে টেনেছে। বই-ই তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার, বদলানোর, আত্মমর্যাদার পথ খুলে দিয়েছে। তবে প্রাথমিকেই শেষ হয়ে যেতে পারত তাঁর পড়ালেখার স্বপ্ন। কারণ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় তাঁর পাহাড়ি গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে ছিল। দুর্গম পাহাড়ি পথ, আর্থিক অসচ্ছলতা, যাতায়াতের পথে নিরাপত্তা এ সবকিছুর কারণে এত দূরে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু তাঁর অদম্য ইচ্ছা, বাবা জনাস প. থমি ও মা এডুইনা সুমের তাঁর পাশে দাঁড়ান চোয়াল শক্ত করে। কুলাউড়ার লক্ষ্মীপুর মিশন স্কুলে ভর্তি হলেন যখন, সেই প্রথম পুঞ্জির বাইরে আসা। সেখানে গারো, খাসি ও সাঁওতাল ছেলেমেয়েরাই বেশি ছিল। ঠিকমতো বাংলা বলতে ও বুঝতে না পারার সমস্যা ছিল। শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় ভাষার এ বাধা উতরে যান। প্রত্যেক শ্রেণিতে ভালো ফলও করেন।

মার্গ্রেট সুমের শিক্ষার উচ্চতর স্তরকে স্পর্শ করে সফলভাবে ঢাকার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করছেন। সফল নারী হিসেবে চলতি বছর পেয়েছেন জয়িতা সম্মাননাও।
মার্গ্রেট সুমের
ছবি: প্রথম আলো

মার্গ্রেট বলেন, তবে চলার পথে আসে ঝড়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৯৬ সালে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর বাবা মারা যান। পরিবারের কঠিন পরিস্থিতিতে বই-খাতা কেনার অবস্থা ছিল না। সহপাঠীদের কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। লক্ষ্মীপুর থেকে এরপর চলে যান সুনামগঞ্জের নারায়ণতলা মিশন স্কুলে। ভর্তি হন নবম শ্রেণিতে। সেখান থেকে ২০০০ সালে ভালো ফল করেই এসএসসি উত্তীর্ণ হন। এরপর যান ঢাকায়। ভর্তি হন মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজে। এবার শুরু হয় পুকুর থেকে সাগরে গিয়ে থাকা। মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন। তবে অর্থাভাবে কখনো প্রাইভেট পড়তে পারেননি। অভাব-অনটন এতটাই তীব্র ছিল, উৎসব-পার্বণ তো দূরের কথা, নিয়মিত পোশাক-আশাক কেনাই কঠিন ছিল। এইচএসসি পাস করে ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু দারিদ্র্য সেটি হতে দেয়নি। স্নাতকে ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। সেখান থেকে ২০১০ সালে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। মার্গ্রেট বলেন, পড়াশোনার এই যাত্রাপথের শেষ পর্যন্ত আসতে পারেন সবখানেই মিশনারি হোস্টেলে থেকে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে।

মার্গ্রেট সুমের প্রথম আলোকে বলেন, ‘পড়ালেখা করছিলাম ঠিকই। কিন্তু লক্ষ্য কী ছিল, বুঝতাম না। খাসিয়াদের মধ্যে পড়াশোনা কম। বাইরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম। তবে ঢাকায় আসার পর প্রথম বড় স্বপ্ন তৈরি হয়। পড়ালেখা করেই কিছু একটা করব পণ করি। কিন্তু ঢাকায় থাকাটা সহজ ছিল না। মিশনারি থেকে কিছু বৃত্তি পেতাম। মা সামান্য কিছু টাকা দিতেন। তাতে কোনোরকম চলত। হাতখরচের টাকা ছিল না। বান্ধবী, মিশনের নানরা কাপড়চোপড় দিতেন। গরিবি জীবনযাপন করেছি।’ মার্গ্রেট হেসে বলেন, ‘এখনো সাধারণ জীবনযাপনই করি।’

ঢাকায় পড়াশোনার সময় বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারে কাজ করা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন মার্গ্রেট। স্নাতকোত্তরের পরে বড়লেখায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কিছুদিন পড়িয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা কারিতাসে সাত বছর কাজ করেছেন। তবে ইচ্ছা ছিল তাঁর দেশের বাইরে পড়াশোনা করার। পরীক্ষা দিয়ে ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড স্কলারশিপ’ জুটিয়ে ২০১৯ সালে চলে যান অস্ট্রেলিয়া। সেখানে দুই বছর থেকে ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে এডুকেশন: লিডারশিপ ও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি নেন। সেখানেও ভালো ফল করেছেন। বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন। এ বছর জুনে বেসরকারি সংস্থা ইন্ডিজেনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেসে (আইপিডিএস) মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এ বছরই শিক্ষা ও চাকরিতে সফল নারী হিসেবে জেলা পর্যায়ে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।

মার্গ্রেট সুমের প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চার বোনের মধ্যে সবাই লেখাপড়া করেছেন। পুঞ্জির ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা কম। শিক্ষা ছাড়া কিছু বদলাবে না। তাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনে কাজ করতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘একটা ভাষায় কথা বলি, পড়েছি আরেকটা ভাষায়। এই ভাষা, দারিদ্র্য, যোগাযোগের পশ্চাৎপদতা, অন্য পরিবেশ—এসব বাধা অতিক্রম করতে পেরেছি মায়ের সমর্থন, অনুপ্রেরণা এবং আমার পড়াশোনার নেশার কারণেই। বাবা মারা যাওয়ার পর মা বড় মেয়ে হিসেবে কাজে লাগিয়ে দিতে পারতেন। তা করেননি। আমি এমন কিছু করতে চাই, যাতে শুধু খাসিয়াই না, সব পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে পারি।’