ছয় ঘণ্টায় ইলিশ যাবে ঢাকায়
বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থেকে সড়কপথে ঢাকার দূরত্ব ৩৩৬ কিলোমিটার। দেশের দক্ষিণের উপকূলীয় এই উপজেলার সদর থেকে ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে ট্রাকে করে মাছ পৌঁছাতে সময় লাগে এখন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই সময় কমে নামবে অর্ধেকে। খরচও কমবে অনেকটাই। মৎস্যজীবীরা বলছেন, একদিকে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে ঢাকার বাজারের ক্রেতারা পাবেন টাটকা ইলিশসহ অন্যান্য মাছ।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মা পারাপারের জন্য সেতু নির্মাণের। এই দাবি পূরণ হওয়ায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নানা খাতের ব্যবসায়ীরাও সমান উৎফুল্ল। পাথরঘাটা বিএফডিসি (বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন) মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত পাইকার, আড়তদার, ট্রলার মালিক ও জেলেসহ মৎস্যজীবীরাও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন গুনছেন। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাথরঘাটা বিএফডিসি পাইকার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে হলে আমরা ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ মাত্র ৬ ঘণ্টায় ঢাকার বাজারে বিক্রি করতে পারব। ক্রেতারা পাবেন টাকটা মাছ। আমাদের লাভ বাড়বে। খরচও কমবে।’
প্রতিদিন ১৪ মেট্রিক টন মাছ
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে এই বিএফডিসি স্থাপিত হয়। এরপর দিন দিন এই মৎস্যবন্দরে মাছ বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে ১৫ জুন পর্যন্ত এই মৎসবাজারে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন মাছ বিক্রি হয়েছে। এই হিসাবে দিনে বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা। তবে ইলিশ মৌসুমে এখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয় বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। বিক্রির টাকার ওপর শতকরা এক টাকা ২৫ পয়সা রাজস্ব আদায় করে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র।
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য পাইকার সমিতি, পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য আড়তদার সমিতি ও বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সূত্রগুলো বলছে, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ইলিশ মাছ ঢাকা ও রংপুরসহ সারাদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এমনকি ভারতেও এখান থেকে মাছ যায়। তবে দূরত্বের কারণে মাছের মান ও উজ্জ্বলতা ঠিক রাখা যায় না। পদ্মা সেতু চালুর পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে পাথরঘাটার টাটকা ইলিশ ঢাকায় পৌঁছে যাবে। এতে তাঁরা সবাই লাভবান হবেন।
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট এম লুৎফর রহমান বলেন, ‘ফেরি পারাপারে কী যে ঝক্কি-ঝামেলা মৎস্যজীবীদের পোহাতে হতো, তা একমাত্র তাঁরাই জানেন! সেতুর ফলে মাত্র ছয় ঘণ্টারও কম সময়ে পাথরঘাটার মাছ পৌঁছে যাবে ঢাকায়। এতে মাছের যেমন চাহিদা বাড়বে, তেমনি সাধারণ জেলেসহ ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।’
যেভাবে কমবে পরিবহন খরচ, সময়
পাথরঘাটা বিএফডিসি ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপক মো. মনির হোসেন জানালেন, পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে ৫ টনের একটি ট্রাক নিয়ে আরিচা ফেরিঘাট হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এতে প্রায়ই কাওরান বাজারসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি সকালের মাছের বাজার ধরতে দেরি হয়। সেতু চালুর পর এই দেরি আর হবে না। খরচও কমবে।
কীভাবে খরচ কমবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরিচা ঘাটে ৫ টনের একটি ট্রাকের জন্য দালাল খরচ দিতে হয় দেড় হাজার টাকা। সিরিয়াল ও ‘লাঠিবাহিনী’বাবদ দিতে হয় ৩০০ টাকা। এরপর ফেরি ভাড়া ১০০০ টাকা। অর্থাৎ শুধু ফেরির জন্য খরচ হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। পদ্মা সেতু চালুর পর এই অতিরিক্ত খরচ লাগবে না। পাঁচ টনের ট্রাকের জন্য সেতুতে টোল লাগবে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
বিএফডিসি ট্রান্সপোর্টের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, পাইকারদের জরুরি বিবেচনায় কিছু মাছ ট্রাকের পরিবর্তে বাসেও দেওয়া হয়। কারণ, বাস কিছুটা আগে ঢাকায় ঢোকে।
সেতু উদ্বোধনের পর এ সমস্যা থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাথরঘাটা থেকে মাছের ট্রাক ছাড়ার পর থেকেই ভীষণভাবে টেনশন কাজ করে। সময়মতো ফেরি পাব কি না। যদি না পারি তবে বরফ গলে মাছ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে দাম পড়ে যায়। লোকসান গুনতে হয়।পদ্মা সেতু উদ্বোধনে এই টেনশন আর থাকবে না। টাটকা মাছ ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারলে মাছের ভালো দাম পাওয়া যাবে। এতে মৎস্যজীবীদের লাভ বাড়বে।’
ইব্রাহিম জানালেন, এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এতদিন মাছের প্যাকেটপ্রতি ৪০০ টাকা ভাড়া নিতেন তাঁরা। সেতু চালুর পর ৫০ টাকা কমিয়ে সাড়ে ৩০০ টাকা করে নেওয়া হবে।
আশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
পাথরঘাটার বলেশ্বর নদসংলগ্ন পদ্মা মৎস্যবাজারে প্রতিদিন রাত ৩টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মাছ বেচাকেনা হয়। এই মৎস্যবাজারের পাইকার রুবেল হোসেন ও আল আমিন হাওলাদার জানালেন, স্থানীয় তরুণরা দীর্ঘদিন ধরেই মোটরসাইকেলে করে মাছ নিয়ে দূর-দূরান্তে টাটকা মাছ বিক্রি করে কিছুটা বাড়তি লাভ করছেন। পদ্মা সেতু চালুর পর তাঁরা ঢাকার বাজারে মাছ নিয়ে যাবেন। এতে পাথরঘাটার ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের টাটকা মাছ ঢাকায় বিক্রি করে আরও বাড়তি লাভ আসবে। এতে করে তাঁদের মতো ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীদের লাভও কিছুটা বাড়বে।
অনেক দিন ধরে মোটরসাইকেলের পেছনে ড্রামে করে এক থেকে দুই মণ মাছ নিয়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে গোপালগঞ্জের পাটগাতি ও টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত বিক্রি করছেন জানিয়ে পদ্মা মৎস্যবাজারে আড়তদার শহীদ নাজির প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে মাছ নিয়ে স্থানীয় পাইকাররা ঢাকার আব্দুল্লাহপুর ও কারওরান বাজার পর্যন্ত যাবেন। এরই মধ্যে আমরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভোর পাঁচটা নাগাদ মাছ নিয়ে রওনা হয়ে বেলা এগারোটা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ঢাকার বাজারে মাছ বিক্রি করব।