চার দিন পর নিভেছে সুন্দরবনের আগুন
সুন্দরবনে লাগা আগুন অবশেষে নিভেছে। বন বিভাগ বলছে, আজ শুক্রবার বনের ওই অংশের কোনো এলাকায় নতুন করে আর আগুন বা ধোঁয়া দেখা যায়নি। চার দিন ধরে ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ, কমিউনিটি টহলদল (সিপিজি) ও স্থানীয় লোকজনের টানা চেষ্টার পর আগুন সম্পূর্ণ নেভানো সম্ভব হয়। গতকাল বৃহস্পতিবারও বনের কিছু অংশে সুপ্ত অবস্থায় আগুন দেখার কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন।
৩ মে সকালে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানী টহল ফাঁড়ি এলাকার ২৪ নম্বর কম্পার্টমেন্টে আগুন লাগে। পানির উৎস দূরে হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগকে। প্রায় তিন মাইল দূরের ভোলা নদী থেকে পাম্প করে পানি নিয়ে চলে আগুন নেভানোর কাজ। দুই দিন চেষ্টার পর মঙ্গলবার দুপুরে একপশলা বৃষ্টিতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। সন্ধ্যায় আগুন সম্পূর্ণ নেভানোর দাবি করে কর্তৃপক্ষ। তবে বুধবার সকালে প্রথমবার আগুন লাগা স্থানের কিছুটা দক্ষিণে আবারও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। থেমে থেমে জ্বলে আগুনও। বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিপিজির সদস্যরা বুধ ও বৃহস্পতিবার দিনভর চেষ্টার পর ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বন বিভাগ বলছে, শুক্রবার নতুন করে কোথাও আগুন দেখা না যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিসকে আর ডাকা হয়নি। তবে ওই এলাকায় পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছেন তারা। বনের ভেতর কোথাও সুপ্ত আগুন দেখা গেলে তা নেভাতে সেখানে পানি জমা করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে প্রয়োজনে পানি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা।
ফায়ার সার্ভিসের শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ স্টেশন কর্মকর্তা মো. আবদুস সত্তার ও সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, ‘শুক্রবার নতুন করে আর আগুন লাগেনি। বন বিভাগ না ডাকায় আমরা আজ আর যাইনি। বৃহস্পতিবার বনের মধ্যে আগুন লাগার এলাকার কাছে আমরা একটি পানির রিজার্ভ রেখে এসেছিলাম। প্রয়োজন হলে বন বিভাগ সেখানে থেকে নিয়ে পানি ছিটাবে। বনে শুকনা পাতার পুরু স্তর। এখন একটা ভালো বৃষ্টি হলে আগুন নতুন করে ছড়ানোর আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।’
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠিত তদন্ত কমিটি শুক্রবার থেকে কাজ শুরু করেছে। সোমবার আগুন লাগার পর ওই দিন বিকেলেই শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. ফরিদুল ইসলাম ও শরণখোলার এসও আবদুল মান্নান। সাত কার্যদিবসের মধ্যে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে (ডিএফও) কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এসিএফ মো. জয়নাল আবেদীন শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর কোথাও আগুন নেই। তবে আমরা এখানে পর্যবেক্ষণে রয়েছি। কয়েক দিন এখানে আমাদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত থাকবে। কোথাও কোনো ধোঁয়া দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা নিভিয়ে দেওয়া হবে। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রায় দুই একরজুড়ে ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে। আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা এখানে বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করছি। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।’
অগ্নিকাণ্ডে ১০ একরের মতো বনভূমি পুড়েছে—স্থানীয় লোকজনের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘এটা এত হবে না। সব জায়গায় তো আগুন লাগেনি। বনের ভেতর কোথাও আগুন লেগেছে, কিছু পুড়েছে। আবার দূরে আরেকটি জায়গায় পুড়েছে। দুই থেকে সর্বোচ্চ আড়াই একর হতে পারে।’
‘আগুন যেমন লাগে, তেমনি আগুন দেওয়াও হয়’
জেলে বা মৌয়ালদের অসাবধানতাবশত ফেলে যাওয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন কিংবা মধু আহরণের সময় ধোঁয়া তৈরির জন্য দেওয়া আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বন বিভাগ। তবে আসছে বর্ষায় মাছ ধরার জন্য বনে আগুন দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা স্থানীয় লোকজনের। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত বলেও জানান তাঁরা।
সুন্দরবনে গেল চার দিন আগুন নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের সঙ্গে কাজ করা সিপিজির এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই ১০ বছর বয়স থেকে শুনি এখানে আগুন লাগে। আমার বয়স এখন ৫০ হবে। আগুন যেমন লাগে, তেমনি আগুন দেওয়াও হয়। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র জড়িত। এখানে বনের ওপরের অংশের মাটি পাতা পচে তৈরি হয়েছে। এই মাটি বিভিন্ন মাছে খায়। আগুন দিলে নতুন করে জমা পাতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সঙ্গে গাছের গোড়াগুলো পুড়ে গর্ত তৈরি হয়। বর্ষায় এই বনভূমি পানিতে তলিয়ে গেলে পুড়ে যাওয়া ওই সব স্থানে প্রচুর মাগুর, শিং, গজার, শোল, কৈসহ জিওল মাছ পাওয়া যায়। অনেক প্রভাবশালী লোক এই মাছ নিয়ে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেন। তাঁরাই বনে আগুন দেওয়ান।’
সিপিজির আরেক সদস্য সগির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এবার আগুন লাগা দাসের ভারানী টহল ফাঁড়ির কাছের ফাঁড়ি চর নাংলী। না হলেও এই দুই ক্যাম্পের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার হবে। বেশি হলে এই দুই ক্যাম্পে সর্বোচ্চ ২০ জন বনকর্মী থাকতে পারেন। তাঁদের কয়েকজন একসঙ্গে ডিউটি করেন, কীভাবে তাঁরা এই বন পাহারা দেবেন! লোকালয়ের একদম কাছের বন। অনেকেই বিনা বাধায় বনে ঢুকে পড়ে। বনে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।’
সচিব পরিদর্শনে যাচ্ছেন কাল
এদিকে আগামীকাল শনিবার সুন্দরবনের আগুন লাগা ওই এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মইনউদ্দীন খান, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার শরণখোলার বলেশ্বর তীরবর্তী বগী এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও সুন্দরবনে আগুন লাগা এলাকা পরিদর্শনের কথা রয়েছে সচিবের।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গেল দুই দশকে বনের এই অংশে অন্তত ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ইতিপূর্বে হওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোয় গঠিত তদন্ত কমিটি মরে যাওয়া বন সংলগ্ন নদ-নদী খনন, সীমান্ত এলাকায় বেড়া এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের সুপারিশ করেছিল, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।