অসময়ে পদ্মায় ভাঙন, বিলীন হচ্ছে বসতভিটা-কৃষিজমি
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট থেকে দেবগ্রাম ইউনিয়নের অন্তারমোড় পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অসময়ের এই ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটসহ আশপাশের গ্রাম ও বসতভিটা। ইতিমধ্যে বহু জমি বিলীন হয়েছে। অনেকে সরে গেছেন নিরাপদ স্থানে।
সরেজমিন দেখা যায়, দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট থেকে দেবগ্রাম অন্তারমোড় এলাকার বাহির চর দৌলতদিয়া, মজিদ শেখের পাড়া, সিদ্দিক কাজীপাড়া, ছাত্তার মেম্বারপাড়া, নতুন পাড়া, লালু মণ্ডলপাড়া, হাতেম মণ্ডলপাড়া, ১ নম্বর ব্যাপারীপাড়া, সাহা ব্যাপারীপাড়া, ঢল্লাপাড়া, আফছার শেখপাড়া, সাহাজদ্দিন ব্যাপারীপাড়া রয়েছে। নতুন পাড়া, ঢল্লাপাড়া, আফছার শেখপাড়া, ১ নম্বর ব্যাপারীপাড়া ও সাহাজদ্দিন ব্যাপারীপাড়ার অধিকাংশ বিলীন হয়েছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে লঞ্চঘাট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান মণ্ডল বলেন, এ মৌসুমে নদীতীরবর্তী ৯টি গ্রামের প্রায় ৮০০ পরিবার ভাঙন আতঙ্কে বসতভিটা ছেড়েছে। বিলীন হয়েছে অন্তত ৩০০ একর কৃষিজমি। এখনো আটটি গ্রামের প্রায় তিন হাজার পরিবার রয়েছে ভাঙনঝুঁকিতে।
ভাঙন রোধের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী আরিফ সরকার বলেন, দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাট আধুনিকায়নে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ২ কিলোমিটার ও লঞ্চঘাটের বিপরীতে ৪ কিলোমিটার নদীশাসনের জন্য পাউবোর বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫১০ কোটি টাকা। বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে।
উপজেলার ১ নম্বর ব্যাপারীপাড়ার কৃষক রেজাউল খান বলেন, শুকনাকালে নদীর এমন ভাঙন আগে তিনি দেখেননি। দুই মাসে চার রশি (এক রশি সমান ৮০ হাত) রাস্তাসহ জমি বিলীন হয়েছে। এ এলাকায় ৪০০ পরিবার ছিল, এখন কেউ নেই। দু-চারটি পরিবারের যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেক জমি আছে। তাই মাঝেমধ্যে দেখার জন্য আসেন। ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত কাজ না হলে সব নদীতে চলে যাবে।
দৌলতদিয়া শাহা ব্যাপারীপাড়ায় নদীর পাড়ে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছিলেন আমেনা বেগম (৬৫)। চার বছর আগে বসতভিটা হারানোর স্মৃতি ভুলতে না পারা এই নারী নদীর পাড়ে ছুটে আসেন প্রায়ই।
আমেনা বেগম বলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। ১০ বিঘা জমি, বাড়ি ছিল। চার বছর আগে তা–ও গেছে। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আজ এক মেয়ের বাড়ি তো কাল আরেক ছেলের বাড়িতে ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন, ‘দুই মাস মাইয়ার বাড়ি থাইকা দুই দিন ধইরা ছেলের বাড়ি আইছি। বউরা ভালো ব্যবহার করে না। তাই বইসা ভাবছি, আল্লাহ তুমি কী বিপদে ফেলাইলা?’
দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের মালিক সমিতির তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আনোয়ার বলেন, ঘাটের উজানে বসতভিটা ও অনেক আবাদি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় পানির স্রোত এখন সরাসরি লঞ্চঘাটে এসে আঘাত হানে। পানি ও স্রোত তুলনামূলক কম থাকায় ঘাট এখনো টিকে থাকলেও সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঘাটটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ট্রাফিক পরিদর্শক আফতাব হোসেন বলেন, শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। ভাঙন বেড়ে গেলে যেকোনো মুহূর্তে ঘাটও বিলীন হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ঘাটটি প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে ক্যানালঘাটে স্থানান্তরের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দীন খান বলেন, লঞ্চ ও ফেরিঘাট আধুনিকায়ন করতে একনেক থেকে বড় বাজেট পাস হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নকশার কাজ শেষ হলে বরাদ্দ পাওয়ামাত্র পাউবোকে নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ কাজ শুরু করবে।
দেবগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান হাফিজুল ইসলাম বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এখনো শুষ্ক মৌসুমে থেমে থেমে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন রোধ করতে না পারলে আগামী দিনে দেবগ্রাম ইউনিয়ন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।