দুই নারীর কীর্তির সাক্ষী চার শ বছরের পুরোনো দুই মসজিদ
আধা কিলোমিটারের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মসজিদ। একই রকম স্থাপত্যশৈলী। সাদা-কালো রং। মাঝবরাবর একটি বড় সুউচ্চ মিনার। দুটি মসজিদই দাঁড়িয়ে আছে আটটি করে স্তম্ভের (পিলার) ওপর। একটি মসজিদের নাম ‘সাহেব বিবি’, অপরটির নাম ‘মইশ্যা বিবি’ মসজিদ। প্রায় চার শ বছরের প্রাচীন এই দুই ইসলামি স্থাপত্যের নির্মাতা ছিলেন চট্টগ্রামের দুই নারী। সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন শাশুড়ি ও পুত্রবধূ। দুটি মসজিদের সঙ্গেই রয়েছে একটি করে দিঘি।
চট্টগ্রামের রাউজান সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সদর ইউনিয়নের পশ্চিম রাউজান গ্রামে মসজিদ দুটির অবস্থান। দুটি মসজিদ ও দিঘি রাউজানের ইতিহাস–ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
কথিত আছে, চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যের প্রসিদ্ধ নারী ‘আলকা বানু’ ও ‘মালকা বানুর’ মা ছিলেন সাহেব বিবি। তিনি জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর স্ত্রী। ১৬১২ সালের দিকে বিদেশি শ্রমিক এনে আঠা ও চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে ৩০ শতক জমির ওপর তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন সাহেব বিবির মসজিদ। এলাকাবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে সে সময় দিঘিটিও তিনিই খনন করান। যা সাহেব বিবির দিঘি নামে পরিচিত। মৃত্যুর পর সাহেব বিবিকে সমাহিত করা হয় তার কীর্তির পাশেই। এ মসজিদ নির্মাণের অর্ধশতাব্দী পরে তাঁর পুত্রবধূ মইশ্যা বিবি কিছু দূরে একই রকম আরেকটি মসজিদ নির্মাণ ও দিঘি খনন করেন। মইশ্যা বিবি মসজিদের অবয়ব আগের মতোই আছে। তবে সংস্কারের ফলে বাইরে থেকে সাহেব বিবি মসজিদটি কিছুটা আলাদা দেখায়।
চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর হয়ে রাঙামাটি সড়ক ধরে ৩০ কিলোমিটার গেলে রাউজান সদরের জলিল নগর বাসস্টেশন। সেখান থেকে গ্রামীণ সড়ক হয়ে অটোরিকশায় করে তিন কিলোমিটার গেলে দুটি মসজিদের দেখা মিলবে। সাহেব বিবির মসজিদের সামনের দিঘিটির নামও সাহেব বিবি দিঘি। মইশ্যা বিবি মসজিদের পাশের দিঘির নাম রাজবাড়ির দিঘি। সাহেব বিবির মসজিদের বর্তমান খতিব রবিউল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মসজিদ দুটি এ দেশের মুসলমানদের পুরোনো নিদর্শন। এ রকম মসজিদ দেশে কয়টি আছে, সেটির পরিসংখ্যান বের করাও কঠিন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। নামাজ আদায় করেন। আমার সৌভাগ্য আমি এখানে ইমামতি করতে পারছি।’
দুটি মসজিদের কয়েক ফুট দূরত্বে রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য আলাদা উঁচু মিনার। নামাজে দাঁড়ানোর কাতার রয়েছে তিনটি। রোজ পাঁচ ওয়াক্ত এবং শুক্রবারের জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় দুটি মসজিদে। একসঙ্গে শতাধিক মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের চার পাশের দেয়াল প্রায় চার ফুট পুরু। শাহি দরজা আছে তিনটি। মসজিদের পাশে ও সামনে রয়েছে চার ফুট উচ্চতার দুটি পাকা মূল ফটক।
সাহেব বিবির মসজিদের সামনে মার্বেল পাথরের ফলকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৯ সালের ১৯ নভেম্বর শেখ ছাদাত অলীকে মসজিদের মোতোয়ালি নিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে দায়িত্ব হস্তান্তর হতে থাকে। ফলকে লেখা সর্বশেষ মোতোয়ালির নাম যোবায়েদ হুমায়ুন চৌধুরী। ২০১৬ সালে তিনি মসজিদটির সংস্কারকাজ করেন। বাইরের দেয়ালের কিছু প্রাচীন কারুকাজ খসে পড়ায় সেখানে বসানো হয়েছে আধুনিক টাইলস।
সাহেব বিবি মসজিদের সামনে দিঘির ঘাটে কথা হয় আমির মুহাম্মদ চৌধুরীর বংশধর দাবিদার ৮৫ বছরের ইউনুছ মিয়া চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি একসময় রাউজান সদর ইউপির সদস্য ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধর তিনি। সাহেব বিবি আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওলের একমাত্র কন্যা ছিলেন বলে তিনি জানান।
সাহেব বিবি ও মইশ্যা বিবি মসজিদের জন্য প্রায় ৫০০ কানি জমি দান করে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর পরিবার। তবে দখল হতে হতে এখন ৪০ কানিও অবশিষ্ট নেই। মসজিদ দুটির এই সম্পত্তি উদ্ধারে দীর্ঘদিন ধরে মামলা পরিচালনা করছেন রাউজান সদর ইউনিয়নের প্রবীণ আইনজীবী মুহাম্মদ রফিকুল আলম। তিনি বলেন, কাগজপত্রে দুটি মসজিদ প্রায় চার শ বছর পুরোনো বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদ দুটি সরকারি কোনো অনুদান পায় না এখনো। প্রাচীন এই স্থাপত্যের সংরক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।