সম্পত্তিই কেড়ে নিল সুফিয়া বেগমের জীবন

নাতনী তাসফিয়ার সঙ্গে ইউনুস মোল্লা
ছবি: প্রথম আলো

তিন বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে তাসফিয়া। এর পর থেকে বাবাও আর খোঁজ রাখেননি। নানি সুফিয়া বেগমের (৫০) কাছেই বড় হচ্ছিল তাসফিয়া। সে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। গত মঙ্গলবার জমিসংক্রান্ত বিরোধে তাসফিয়ার নানিকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। নানিকে হারিয়ে তাসফিয়া এখন দিশাহারা। তাসফিয়া কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারছে না। বাক্‌রুদ্ধ নানা ইউনুস মোল্লা তাসফিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সান্ত্বনা দিয়ে আড়ালেই চোখ মোছেন ইউনুস মোল্লা।

গত মঙ্গলবার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে সুফিয়া বেগমকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের দেবর লিয়াকত আলী মোল্লাকে (৪৮) ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে কাশিয়ানী ও কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ।

গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে গোপালগঞ্জের কথা হয় ইউনুস মোল্লার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগে তাঁর বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ে ফরিদপুর ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর স্ত্রীই নাতনির লালন-পালন সবই করতেন। এখন কীভাবে নাতনি আর মেয়েকে নিয়ে থাকবেন, তা বুঝতে পারছেন না তিনি। ইউনুস মোল্লার দাবি, তাঁর আপন ভাই লিয়াকত আলী গাছের সঙ্গে বেঁধে সুফিয়ার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছেন।

ইউনুস মোল্লা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ইউনুস মোল্লা দ্বিতীয়, লিয়াকত চতুর্থ। ইউনুস মোল্লা বলেন, তাঁর ভাই লিয়াকতও পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করতেন। তবে ১৭ বছর চাকরি করার পর জুয়া খেলার অপরাধে লিয়াকত চাকরিচ্যুত হন বলে দাবি করেন ইউনুস মোল্লা।

ইউনুস মোল্লা বলেন, ‘চাকরিচ্যুত হওয়ার পর লিয়াকত তার ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় অন্য লোকের কাছে। লিয়াকতের খারাপ অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী সুফিয়া লিয়াকতকে ওই জমি ফিরিয়ে এনে দিয়ে তাকে একটা ঘর করে দেয়। দুই বছর পর লিয়াকত আবার জমিসহ ওই ঘর বিক্রি করে। কিছুদিন ধরে সে আমার বাড়ি থেকে জমি দিতে বলে। কিন্তু আমার স্ত্রী এ কথায় রাজি ছিল না।’

লিয়াকত এই ক্ষোভ থেকেই সুফিয়াকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেন ইউনুস মোল্লা। স্ত্রীর মৃত্যুর বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘ওই দিন সকালে আমি দোকানে ছিলাম। তাসফিয়াকে স্কুলে দিয়ে আমার স্ত্রী ঘরের মধ্যেই ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘর থেকে বের হয়ে পানি আনতে যায়। তখন আমার ছোট ভাই লিয়াকতসহ আরও দুজন আমার স্ত্রীকে হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে উঠানের পেয়ারাগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এরপর সুফিয়ার পরনের ওড়না ও ঘর থেকে গামছা এনে তার মুখ বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে যখন গামছা পুড়ে যায়, তখন সুফিয়া চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে আমাকে কল করেন।’

অভিযুক্ত লিয়াকত পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তবে কখন গ্রামে এসেছেন, সেটা ইউনুস মোল্লা জানেন না। তাঁর দাবি, বাড়ির পাশেই লিয়াকত তাঁর ভাই মৃত আবদুর রহমানের স্ত্রী শিউলি ও ছেলে সোহেল মোল্লার সঙ্গে লিয়াকত যোগাযোগ রাখতেন। আগুন দেওয়ার সময় তাঁরা দুজনই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন বলে দাবি করেন ইউনুস মোল্লা। তবে এ ঘটনার পর থেকে শিউলী ও সোহেল পলাতক।

কাশিয়ানী থানার উপপরিদর্শক ও মামলা তদন্ত কর্মকর্তা দেওয়ান সাদিকুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় মঙ্গলবার নিহতের ভাই আক্তার হোসেন বাদী হয়ে দুজনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন-চারজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে লিয়াকত আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িত থাকলে তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।