ওজন নিয়ে উপহাসের শিকার নবীনের জীবনে আশার আলো
শারীরিক অবয়ব নিয়ে উপহাসের ভয়ে আবদুল্লাহ আল নবীন একসময় ঘর থেকে বের হতেন না। স্কুলেও যেতে অনীহা ছিল। কারণ, তাঁর ওজন ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। নবীনের স্থূলতা নিয়ে সহপাঠীরাও নানাভাবে হাসি-তামাশা করত।
এমন অবস্থায় গুটিয়ে যেতে শুরু করেন নবীন। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে কাঁদতেন। তবে একদিন দৃঢ়সংকল্প নিয়ে নবীন শুরু করেন কঠোর ব্যায়াম। মাত্র সাত মাসে ফলও পেয়েছেন তিনি। ৬৬ কেজি ওজন ঝরিয়ে নবীন এখন ঝরঝরে এক তরুণ। তাঁর বর্তমান ওজন ৯৪ কেজি। উচ্চতা ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি।
আবদুল্লাহ আল নবীন বরিশাল নগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশপুরের বাসিন্দা। এখন তাঁর বয়স আঠারো। নগরের আমানতগঞ্জ এলাকার ইসলামিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র।
সাত মাসের কঠোর ব্যায়ামের সময় নবীন প্রতিদিন নিয়ম মেনে খাবার খেতেন। প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম ভাত বরাদ্দ ছিল। দুপুরে ১৫০ গ্রাম মুরগি আর ৩০০ গ্রাম সবজি।
সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া নবীনের ওজন বেড়ে যেতে শুরু করে আট বছর বয়সের দিকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় নবীনের ওজন ছিল ১০৫ কেজি। এরপর তা বেড়ে ১৬০ কেজিতে দাঁড়ায়। ওজন যত বাড়ে, নবীন ততই বডিশেমিংয়ের (শারীরিক অবয়ব নিয়ে কটাক্ষ) শিকার হতে থাকেন।
গতকাল সোমবার রাতে বরিশাল নগরের সদর রোডের একটি ব্যায়ামাগারে নবীনের সঙ্গে আলাপ হলো। সাত মাসের কঠোর পরিশ্রম করে ৬৬ কেজি ওজন ঝরানোর গল্প উঠে এল সেই আলাপে। কথা বলার সময় নবীনের চোখ কখনো জলে ভিজে আসে, আবার কখনো চেহারায় ফুটে ওঠে কঠিন আত্মবিশ্বাস।
নবীনের বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন একজন সেনাসদস্য। মা গৃহিণী রোজিনা বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ছোট ভাই মো. আরিফ মাধ্যমিকের ছাত্র। নবীন বলেন, ছোটবেলা থেকেই নবীনের খাওয়াদাওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। বাবা-মাও বারণ করেননি। খাবারের প্রতি আকর্ষণই একসময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলে গেলে সহপাঠীরা কেউ তাঁর পাশে বসতে চাইত না। এ জন্য তিনি স্কুলে যেতে চাইতেন না। বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের কাছ থেকে তীর্যক মন্তব্য আর ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
তবে নবীনের মা-বাবা সব সময় তাঁর পাশে ছিলেন। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই এই পরিস্থিতি থেকে তাকে বের করতে পারছিল না। ২০২১ সালে এসএসসি পাসের পর কলেজে ভর্তির পর সেখানে আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হন নবীন। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে নবীনের চোখ জলে ভিজে এল।
নবীন বলেন, ‘আর দশটা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো আমিও তো বন্ধুত্ব করতে চেয়েছি আমার সহপাঠীদের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের কাছে গেলে আমাকে দূরে সরিয়ে দিত। রাস্তায় নামলে সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাত যেন আমি মানুষ নই, ভিন্ন কোনো প্রাণী।’
নবীনের এসব বর্ণনা ছিল মর্মস্পর্শী। তবে মুহূর্তেই আত্মিবিশ্বাসী হয়ে নবীন বলেন, ‘গত বছর জানুয়ারিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক আমার ওজন কমাতে হবে। এরপর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শহরের একটি ব্যায়ামাগারে এসে প্রশিক্ষক জাহাঙ্গীর কবীরের কাছে নিজের সংকল্পের কথা জানাই। তিনি ও আবদুল্লাহ আল মুবিন ভাই আমাকে অনুপ্রেরণামূলক নানা কথা বলেন। আমি আরও সাহসী হই। এরপর নেমে পড়ি সংগ্রামে।’
প্রতিদিন সাড়ে তিন ঘণ্টা কঠোর ব্যায়াম করতেন নবীন। শুরুতে কিছুটা শিথিল। দিনে দিনে ব্যায়াম হয়ে ওঠে কঠোর থেকে কঠোরতর। নবীনের প্রশিক্ষক জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘প্রথম দিকে ও এসে শুধু কাঁদত আর বলত, “আমি কি স্লিম হতে পারব? আমি কি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারব?”। তবে আমি সব সময় নবীনের মধ্যে দৃঢ়সংকল্প দেখেছি। আমি যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছি, নবীন তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে।’
সাত মাসের কঠোর ব্যায়ামের সময় নবীন প্রতিদিন নিয়ম মেনে খাবার খেতেন। প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম ভাত বরাদ্দ ছিল। দুপুরে ১৫০ গ্রাম মুরগি আর ৩০০ গ্রাম সবজি। রাতে ১০০ গ্রাম মুরগি, ২০০ গ্রাম সবজি। সকালে ১০টি লেবুর রস আর দুটি ডিম। বেলা বাড়লে আপেল ও কলা থাকত খাবারের তালিকায়। ব্যায়াম শুরুর এক মাসের মধ্যেই ফল পেতে শুরু করেন নবীন।
নবীন বলেন, ‘শুরুতে জিম থেকে বাসায় ফিরে খুব ব্যথা হতো। তবে আমি হাল ছাড়িনি। গত বছরের জুলাইতে এসে ওজন ৯৪ কেজিতে স্থির হয়েছে। এখনো খাবারের তালিকা নিয়মমাফিক। তালিকায় শর্করাজাতীয় খাবার খুবই কম থাকে। তবে প্রোটিন আছে, এমন খাবার বেশি খাই। এর পাশাপাশি প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা ব্যায়ামও চলছে।’
এ ধরনের ব্যক্তিদের ছয় মাসে ১০ শতাংশ ওজন কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি। তারপরও যদি বেশি কেউ কমাতে চায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে।এম কে আজাদ, মেডিসিন, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
স্থূলতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশে নবীন বলে, ‘মানুষের পক্ষে কোনো কিছুই দুঃসাধ্য নয়। আমি নিজেই তার উদহারণ। তবে এ জন্য প্রয়োজন কেবলই ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ় মনোবল।’
তবে দ্রুত ওজন কমানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ (প্রেষণ) এম কে আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত আমরা এ ধরনের ব্যক্তিদের ছয় মাসে ১০ শতাংশ ওজন কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি। তারপরও যদি বেশি কেউ কমাতে চায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কিডনির সমস্যা, ফ্যাটিলিভার, বিরক্তিভাব, ভুলে যাওয়া, শরীরে লবণের তারতম্যসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি থাকে।’