‘শীতে শরীরটা কোঁকড়া নাগে রগ বাঁকা হয়া যাওছে’
তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। সকাল থেকে ঝরছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা। এমন অবস্থায় কাবু হয়ে পড়েছেন রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জের শীর্তাত মানুষ। তেমনি একজন তারাগঞ্জের ফকিরপাড়া গ্রামের লাবিনা বেগম (৬৫)। শীতে কাতর হয়ে দুই নাতনিকে নিয়ে বাড়ির পাশে আগুনে শরীর গরম করেছিলেন তিনি।
খড়কুটোর আগুনের শিখায় দুই হাত বাড়িয়ে লাবিনা বেগম বলেন, ‘মনটা কাওছে গাওত আগুন নাগে থাকো। ঠান্ডাতে জানটা বের হয়া যাওছে। শরীরটা কোঁকড়া নাগে রগ বাঁকা হয়া যাওছে। ওই জন্যে আগুন পোহার আইনো। গরম কাপড় নাই, আগুনোত গাও শেখি আরাম নাগোছে।’
মাঘের শীতে কাবু হয় দুই শিশু নাতনিকে নিয়ে আগুনের আঁচ শরীরে আরাম দিলেও তা যে কতটা অনিরাপদ, সে কথা ভুলে গেছেন লাবিনা বেগম। শুধু লাবিনা বেগম নন, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দলবদ্ধ হয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন অনেকেই। কেউ মাঠে, কেউ উঠানে, কেউ আবার বাজারে আগুনে গা তাপাচ্ছেন।
আজ শুক্রবার দুপুর ১২টায় তারাগঞ্জের মাটিয়ালপাড়া মাঠে দিনমজুর স্বামীর জন্য গামলায় ভাত নিয়ে কাপড়ে বেঁধে মাথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন জুম্মাপাড়া গ্রামের গৃহবধূ সায়না বেগম। সঙ্গে তাঁর ৪ বছরে মেয়ে। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সায়না বেগম বলেন, ‘ভাইজান, এবার খুব ঠান্ডা। ঝরি মতন শীত পড়োছে। দুপুর হইছে বেলার দেখা নাই। গাও গডগড করি কাঁপোছে। পেট তো আর ঠান্ডা মানে না। ভাত নিয়া যাওছি দোলাত নাড়া ওকড়ি আগুন জ্বালে স্বামীক ভাত খাওয়ামো, গাও তাপামো।’
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারাগঞ্জের ইকরচালী, ফকিরপাড়া, জুম্মাপাড়া, বামনদীঘি, মাটিয়ালপাড়া ও বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি, শাহাপুর, কাচাবাড়ি, রাধানগর, পাটানপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শীতের তীব্রতায় কাবু হয়ে পড়েছে শিশু-বৃদ্ধসহ প্রাণিকুল। ঘন কুশায়া জনপদ ঢেকে থাকায় দিনের বেলায়ও লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। বিশেষ করে দরিদ্র দিনমজুর পরিবারগুলো পড়েছে বিপাকে। হাটবাজারে মানুষের উপস্থিতিও কমেছে। গ্রামের মোড়ে, বাড়ির উঠানে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে শরীর তাপাচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালগুলো বেড়েছে শীতজনিত রোগীর ভিড়।
ধান রোপণে ব্যস্ত দিনমজুর মিঠু ইসলাম শীতে ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। কথা হলে মিঠু ইসলাম বলেন, ‘পানি হিয়াল ঠান্ডা হইছে, মাথার মগজে ধরোছে। ওপর নিচ চারদিকে ঠান্ডা আর ঠান্ডা। ২০ শতক জমি ধান লাগা চুক্তি নিছনো। অর্ধেক ধান নাগে বাড়ি যাওছে। এটে আর বেশিক্ষণ থাকলে জীবন হারে যাইবে।’
হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুমারেশ রায় বলেন, ‘হঠাৎ শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় দুস্থ লোকজন কম্বলের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ভিড় করছেন। কিন্তু কম্বল বরাদ্দ না পেলে তাঁদের কোথা থেকে দেব। অনেকে গালমন্দ করে চলে যাচ্ছেন।’
আমরুলবাড়ি গ্রামের রিকশাচালক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘গরিব মানুষের সউগটে মরণ। গরম কন, ঠান্ডা কন, একটাও সয় না। শীতোর যাত্রী নাই, কামাই কমি গেইছে। শরীরে মোটা কাপড় নাই, বাইরোত থাকির পাওছি না। এবার ঠান্ডা হাড়ে হাড়ে টের পাওছি।’
পাটানের হাট বাজারে ব্যবসায়ী মিঠু মিয়া বলেন, তিন দিন ধরে বাজারে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত দুই–চারটা লোক থাকলেও পাঁচটার পর পুরো হাট ফাঁকা হয়ে যায়। শীত বাড়ায় ব্যবসা–বাণিজ্যেও মন্দা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে তারাগঞ্জের ইউএনও রুবেল রানা বলেন, কয়েক দিন ধরে শীতের তীব্রতা একটু বেশি। দরিদ্র শীতার্তদের মধ্যে ২ হাজার ৮০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। আরও কম্বল বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, সকাল ৯টায় রংপুর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কাল তাপমাত্রা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।