সম্রাট, মহারাজ, রেশমা সুপারসহ ছয় জাতের পেঁয়াজ বীজ এনেছেন এই কৃষক

খেতে পেঁয়াজগাছের পরিচর্যা করছেন হাফিজ উদ্দিন। ১৪ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর চড়োল পতিলাভাষা মাঠেছবি: প্রথম আলো

হাফিজ উদ্দিন মৃধা তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। বড় ভাই একদিন ডেকে বললেন, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তোকে দুই ক্লাস বেশি পড়ালাম। এখন লাঙল ধর।’ ভাইয়ের এ কথা শুনে শিশু হাফিজ মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। বাবা নেই, তাই মা সেদিন কিছু করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে কলম ছেড়ে লাঙল ধরেন হাফিজ। তবে তিনি লাঙলেই ফলিয়েছেন সোনা।

এখন মাটিতে হাত দিলেই বুঝতে পারেন, কোন মাটি পেঁয়াজের। সংকরায়ণের মাধ্যমে পেয়েছেন ছয় জাতের বীজ। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ১৪ জেলায় ছড়িয়ে আছে সেই পেঁয়াজবীজের বাজার। তাঁর রয়েছে সাড়ে ৩০০ কন্টাক্ট ফারমার (চুক্তিবদ্ধ চাষি)। হাফিজ উদ্দিন (৫৭) সেই চাষিদের বপনের জন্য বীজ দেন, বিনা সুদে ঋণ দেন। তাঁদের উৎপাদিত পেঁয়াজবীজ নিয়েও চাষির দুশ্চিন্তা থাকে না। সব বীজ তিনিই নগদ টাকায় কিনে নেন। এভাবে তিনি নিজের পাশাপাশি দিন বদলে দিয়েছেন ভিটেমাটিহীন শতাধিক চাষির। কেউ জায়গাজমি কিনছেন, কেউ পাকা ঘরবাড়ি করেছেন।

সাধারণ পেঁয়াজ সহজে পচে যায়। চাতালে বেশি দিন টেকে না। একাধিক কন্দবিশিষ্ট হয়, ফেটে যায়। সংকরায়ণের মাধ্যমে পাওয়া হাফিজের বীজের পেঁয়াজ হয় এক কন্দবিশিষ্ট, এক মাপের ও চাতালে টেকে বেশি দিন। তাই চাষিরা ঝুঁকেছেন তাঁর বীজের দিকে। গত বছর হাফিজ উদ্দিনের উৎপাদিত পেঁয়াজবীজের পরিমাণ ছিল ২৯ মেট্রিক টন। এবারের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ মেট্রিক টন। তাঁর জীবনের ৩২ বছরের লড়াই তাঁকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এই কৃষকের বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মেলান্দি গ্রামে।

হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর উৎপাদিত পেঁয়াজ ও বীজ দেখছেন স্বশিক্ষিত কৃষি বিজ্ঞানী নুর মোহাম্মদ ও বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির কর্মকর্তারা
ছবি: প্রথম আলো

বীজের নাম

সংকরায়ণের মাধ্যমে পাওয়া নতুন ছয় জাতের বীজের নাম তিনি নিজেই দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে সম্রাট, সুপার গোল্ড, সুপার কিং, মহারাজ, রেশমা সুপার ও কুইন-তাহেরপুরী। এর মধ্যে রেশমা সুপার বীজের নামকরণ করেছেন তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর নামে। এই বীজের বাজার এখন রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, লালমনিরহাট এবং পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলার কিছু অংশে।

গাজীপুরে অবস্থিত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রধান কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এটি ‘মানঘোষিত’ বীজ। অর্থাৎ চাষিরা ভালো বীজ হলে নিজেই ‘ভালো বীজ’ বলে ঘোষণা দিয়ে বিক্রি করতে পারেন।

রাজশাহীর বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পেঁয়াজের বীজ ‘অনিবন্ধিত’। এ নিয়ে তাঁদের কিছু বলার থাকে না। নিবন্ধিত বীজ যেমন ধান ও গমের বীজের ক্ষেত্রে নতুন কোনো জাত কেউ বাজারে আনতে চাইলে, তাঁদের মাধ্যমে প্রত্যয়ন করতে হবে। আর অনিবন্ধিত বীজের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো অনুমোদন লাগে না।

বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির তথ্যমতে, দেশে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজবীজের চাহিদা রয়েছে।

সংকরায়নের মাধ্যমে ছয় জাতের পেঁয়াজের বীজ এনেছেন হাফিজ উদ্দিন
ছবি: প্রথম আলো

সতর্কতা

বীজের স্বকীয়তা রক্ষার জন্য হাফিজ উদ্দিন চাষের সময় গোপনীয়তা রক্ষা করেন। মাঠে যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা বলতে পারেন না তিনি কোন জাতের বীজ ফলাচ্ছেন। তাঁকে শুধু একটি কোড নম্বর দেওয়া হয়। একমাত্র হাফিজ উদ্দিনই জানেন, কোন কোডে কী বীজ হবে। আবার নির্দিষ্ট একটি এলাকায় তিনি বীজ চাষ করেন না।

ঠাকুরগাঁও থেকে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর সাড়ে ৩০০ চাষির জমি। কৌশলগত কারণেই হাফিজ উদ্দিন তা করেন। এটা করেন প্রথমত, উপযোগী মাটি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য। তিনি মাটি হাতে নিলেই বলে দিতে পারেন, ওই মাটিতে ভালো পেঁয়াজ হবে কি না। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ একসঙ্গে সব এলাকায় হয় না। কোনো একটি এলাকায় শিলাবৃষ্টি হলে বীজের সর্বনাশ হয়ে যায়। এ জন্য তাঁর খামার দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়ানো। একটি এলাকায় দুর্যোগ হলেও অন্য এলাকার বীজ তাঁকে বাঁচায়। হাফিজ উদ্দিন জানান, এ সবই তাঁর ৩২ বছর ঠেকে ঠেকে শেখা কৌশল।

মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, তিনি হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়েছেন। তাঁর বীজ দেখেছেন। তাঁর উৎপাদিত বীজের মান ভালো।

যেভাবে শুরু

হাফিজ উদ্দিন তখন শুধু ধান চাষ করতেন। এ সময় মোহনপুর উপজেলার বেলনা গ্রামের মফিজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি পেঁয়াজবীজের চাষ করতেন। একদিন হাফিজ তাঁর কাছে গিয়ে পেঁয়াজবীজের আবদার করলেন। মফিজ উদ্দিন পরের মৌসুমে হাফিজকে সাড়ে সাত কেজি পেঁয়াজ দেন। বাড়ির ভিটায় বপন করেন। ছাগলে নষ্ট করার পরও দেড় কেজি বীজ থেকে চারা গজাল। ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেন। এভাবে করতে করতে একবার দুই বিঘা জমিতে চাষ করলেন। চার মণ বীজ হলো। পাটের বস্তায় রাখলেন। সেই বীজ থেকে আর চারা গজাল না। যে চাষিদের বীজ দিয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে আর দাম নিতে পারলেন না। এবার বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে গেলেন। তাঁরা ধারণা পাল্টে দিলেন। বীজ সংরক্ষণ করতে হবে মুড়ির টিনে অথবা ব্যারেলে ভরে। যাতে ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে।

নতুন বাজারের ঠিকানা

২৫ বছর আগের কথা। সেবার পাঁচ মণ বীজ হলো। স্থানীয় বাজারে ৫০০ টাকা কেজি দরে সেই বীজ বিক্রি করলেন হাফিজ। সে সময় এক প্রতিবেশী তাঁর কাছ থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে বীজ নিয়ে পাবনায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বিক্রি করেন। মৌসুম শেষে হাফিজের কাছে ১২ কেজি বীজ ছিল। সেই প্রতিবেশী ৮০০ টাকা কেজিতে সব বীজ নিতে চাইলেন। এবার হাফিজ উদ্দিন এক শর্তে তাঁকে বীজ দেন। তাঁর সঙ্গে তিনি পাবনায় যাবেন। পাবনায় গিয়ে শোনেন, সবার মুখে শুধু ‘দানা’ নিয়ে কথা। স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজবীজকে সেখানে দানা বলে। কাশীনাথপুর বাজারের হাশেম নামের এক দরজিকে সব বীজ দিয়ে আসেন হাফিজ। শর্ত দিয়ে আসেন—বীজ গজালে টাকা, না গজালে কোনো টাকা দিতে হবে না। কিছুদিন পর খবর পেলেন, সেই বীজ থেকে চারা ভালোই গজিয়েছে। পাবনার চাষিরা খুশি হয়ে সেই বীজের দাম দেন আড়াই হাজার টাকা কেজি করে। এবার তাঁর চোখ খুলে যায়। পাবনার বাজার তাঁর দখলে আসে। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বীজের চাহিদা এত বেড়ে যায় যে হাফিজ উদ্দিন ‘কন্টাক্ট ফার্মিং’ শুরু করেন। চাষিদের বপন করার জন্য পেঁয়াজ দেন। বিনা সুদে ঋণ দেন। পেঁয়াজবীজ উঠলে তিনি সব কিনে নেন। তাঁদের নিয়ে মাঠ দিবস করেন। মৌসুম শেষে শহরের বড় হোটেলে অনুষ্ঠান করে দক্ষ চাষিদের পুরস্কৃত করেন। সেখানে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থাও থাকে।

মাঠ থেকে মাঠে

পেঁয়াজচাষিরা জানান, এক কেজি বীজ ৩৩ থেকে ৪৫ শতাংশ জমিতে ছিটানো যায়। এক বিঘায় পেঁয়াজ হয় ৭০ থেকে ৮০ মণ। গত বছর এক কেজি বীজ পাইকারি সাড়ে তিন থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

হাফিজ উদ্দিনের সাড়ে ৩০০ খামারির মধ্যে ২৫০ জনই ঠাকুরগাঁওয়ের। হাফিজ উদ্দিন বলেন, কোনো চাষি তাঁর বীজ নিতে চাইলে প্রথমেই তিনি তাঁর জমির মাটি দেখেন। মাটি হাতে নিলেই তিনি বলে দিতে পারেন, ওই মাটিতে ভালো পেঁয়াজ হবে কি না।

গোদাগাড়ীর জলাহার গ্রামের এনামুল দিনমজুরি করতেন। হাফিজ উদ্দিন তাঁকে চাষি বানিয়েছেন। এবার তাঁর আট বিঘা জমিতে পেঁয়াজবীজ আছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজবীজ চাষ করে বাড়ির ভিটা ও এক বিঘা চাষের জমি কিনেছেন।

১৪ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের মাঠ দেখতে গিয়ে মনে হলো, ঠাকুরগাঁও যেন হাফিজ উদ্দিনের নিজের এলাকা। চাষিদের সবার নাম ধরে কথা বলছেন।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লংকাপুর গ্রামের সোম্বারু সিংহের (৬৫) বেড়ার ঘর ছিল। এখন ইটের বাড়ি করেছেন। বাড়িতে যেতেই চওড়া হাসি দিলেন। তিনি একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত চাষি।

ফরিদপুর পেঁয়াজবীজের জন্য প্রসিদ্ধ। সেখানে হাফিজ উদ্দিনের বীজের ভালো ব্যবসা। জেলায় তাঁর ১৪ জন ডিলার রয়েছেন। নগরকান্দা উপজেলার ডিলার মনির হোসেন মোল্লা মুঠোফোনে বলেন, ‘ফরিদপুরের অর্ধেক বাজার হাফিজ ভাইয়ের একার; আর বাকি অর্ধেক অন্য সব কোম্পানির। দোকানে এসে ক্রেতারা প্রথমেই হাফিজ ভাইয়ের বীজটা চান।’

বাড়িতে একদিন

হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে যাওয়ার কোনো সরকারি রাস্তা ছিল না। তিনি নিজে জায়গা কিনে রাস্তা তৈরি করেছেন। উপকৃত হয়েছেন পাড়ার সব মানুষ। তাঁর দোতলা বাড়ির নিচতলা যেন একটি কারখানা। বীজ তোলার মৌসুমে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ প্যাকেটে ভরছেন, কেউ প্যাকেটের মুখ সেলাই করছেন; কেউ গ্রেডিং মেশিনে, কেউ কৌটার মুখে সিল মারছেন—সে এক কর্মযজ্ঞ।

হাফিজ উদ্দিন বলেন, তাঁর বড় ভাই তাঁকে দুই ক্লাস বেশি (সপ্তম শ্রেণি) পড়িয়েছেন। তিনি তাঁর ছোট ভাইকে এমএ পাস করিয়েছেন। জায়গাজমি যা করেছেন, সব তিন ভাইয়ের নামেই কিনেছেন। চাষিদের সঙ্গেও তিনি এই সততার সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন।