হঠাৎ ‘ওরস বিরিয়ানি’র দিকে কেন ঝুঁকছে মানুষ
সারি করে বসানো হয়েছে চেয়ার। টেবিলে পেতে রাখা হয়েছে শানকি। শানকিতে ইফতারের পরিচিত পদ ছোলা, পেঁয়াজু কিংবা বেগুনি নেই। আছে ‘ওরস বিরিয়ানি’। সাইরেন বাজতেই শুরু হলো খাওয়া-দাওয়া। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি এলাকায় গিয়ে এ চিত্র চোখে পড়ল।
সিআরবিতে ‘ওরস হাইলে আইয়ুন’ নাম দিয়ে টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা। প্রতিদিন ইফতারের সময় দুই থেকে আড়াই শ রোজাদার সেখানে মিলিত হচ্ছেন। ফুলপ্লেট ১২০, হাফপ্লেট ৭০ টাকায় ওরস বিরিয়ানির স্বাদ নিচ্ছেন তাঁরা। সঙ্গে আরও আছে ঐতিহ্যবাহী মেজবান। চেয়ার-টেবিলের পাশেই সাতটি ডেকচিতে চলে রান্না। প্রতিদিন ১১৫ কেজি গরুর মাংস, ১২০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু ও ১ কেজি গাজরের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এই মুখরোচক পদ।
বিরিয়ানি তৈরির এই কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ হানিফ বাবুর্চি। তিনি জানান, গত প্রায় দেড় যুগ তিনি বিভিন্ন জায়গায় ওরস বিরিয়ানি রান্না করছেন। চাল, মাংস, আলু ও মসলার পরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে এ খাবার ভোজনরসিকদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। দরবার থেকে চলে এসেছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়। সাত ডেকচিতে ইফতার থেকে সাহ্রি পর্যন্ত ২ হাজার ১০০ জন খেতে পারেন।
এবার পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার পর নগর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ওরস বিরিয়ানি হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা থেকে সাহ্রি পর্যন্ত অস্থায়ী দোকানগুলোতে চলছে মাংস কাটাকাটি, বিরিয়ানি তৈরি ও বেচাবিক্রি। নগরের অলিগলির রেস্তোরাঁ, হোটেলে ঢুঁ মারলেই এই ওরস বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে লাগছে। দল বেঁধে বন্ধুরা যাচ্ছেন ওরস বিরিয়ানির স্বাদ নিতে।
গতকাল সন্ধ্যায় সিআরবিতে কথা হলো রাজ্জাক সরকার, সেলিম উদ্দিন ও রায়হান মাহমুদের সঙ্গে। তাঁরা তিন বন্ধু এসেছিলেন এই বিরিয়ানি চেখে দেখতে। ১২০ টাকা দরে তিন প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। ইফতারের পর একফাঁকে প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ওরস বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই বিরিয়ানির ছবিসহ অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন। তাই শেষমেশ তাঁরাও চলে এলেন। খেতে কেমন লাগল, এমন প্রশ্নে সেলিম একশব্দে জবাব দিলেন, ‘দারুণ।’
তবরুক থেকে বিরিয়ানি
হাল আমলের ওরস বিরিয়ানি একসময় তবরুক হিসেবে মাজারে রান্না হতো। তবে সে ইতিহাসে ডুব দেওয়ার আগে বিরিয়ানির ইতিবৃত্ত জানা যাক। সুগন্ধি চালের সঙ্গে হরেক পদের মাংস, বিভিন্ন মসলা মিশিয়ে রান্না করা হয় বিরিয়ানি। ২০১৭ সালে ‘বিরিয়ানি’ নামে কুকবুক প্রকাশ করেন ভারতীয় লেখিকা প্রতিভা করণ। এ বইয়ে তিনি বিরিয়ানির উৎপত্তি, ভারতবর্ষে এটির আগমন ও অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইতে তিনি লিখেছেন: ১৬ শতকে মুসলিম শাসকেরা ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় তাঁরা পারস্য থেকে ভারতবর্ষে বিরিয়ানি বানানোর কৌশল নিয়ে আসেন। বিরিয়ানি শব্দটি ফারসি ‘বিরিঞ্জ’ শব্দ থেকে এসেছে। এটি ভাতের ফারসি প্রতিশব্দ।
মূলত মোগলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে আসা রাজকীয় খাবার বিরিয়ানি ছড়িয়ে গেছে অঞ্চলে-অঞ্চলে। এটির অস্তিত্ব ছিল চট্টগ্রামের মাজারগুলোতেও। ইতিহাস ধরে পেছনে গেলে নাম আসে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরিফের। মাইজভান্ডার নিয়ে গবেষণা করেছেন গবেষক সেলিম জাহাঙ্গীর। ওরস বিরিয়ানির ইতিহাস সম্পর্কে তিনি জানান, প্রায় ১০০ বছর আগে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরিফে বার্ষিক ওরসে মাংস ও ভাত বিতরণ হতো। তখন মাংস, ডাল ও ভাত রান্না হতো আলাদা আলাদা।
তবে মুক্তিযুদ্ধের পর দরবারে জনসমাগম বাড়তে থাকে। ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ ওরসে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। তখন আলাদা আলাদা পদ রান্না করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে সময় বাঁচাতে চাল ও মাংসের সংমিশ্রণে তবরুক তৈরি হতে লাগল, যা এখন ওরস বিরিয়ানি নামে পরিচিতি পেয়েছে। দিনরাত জিকির-আসকার ও মিলাদ মাহফিলের পর এই তবরুক বিতরণ করা হতো।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, কালের পরিক্রমায় মাইজভান্ডার দরবার শরিফ থেকে ওরসের এই তবরুক রান্না ছড়িয়ে পড়ে আরও বেশ কিছু মাজারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনোয়ারার ওষখাইন সৈয়দ আলী রজা কানু শাহ, তালসরা দরবার, চন্দনাইশের সাতবাড়িয়া দরবার।
বিভিন্ন মাজারের রসুইঘর থেকে এই বিরিয়ানি পৌঁছে গেছে রেস্তোরাঁয়। চট্টগ্রাম নগরের ‘সেভেন ডেজ’ ২০১৬ সাল থেকেই ওরসের বিরিয়ানি বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জি এম মনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের রেস্তোরাঁয় বেশ কয়েক পদের খাবার রয়েছে। তবে ওরস বিরিয়ানির বিক্রি বেশি।
মইজ্জারটেকে উৎসব
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে এখন যেন ওরস বিরিয়ানির উৎসব চলছে। মইজ্জারটেক এলাকা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের মিল্ক ভিটা গেট পর্যন্ত অন্তত ১০টি দোকানে চলছে কেনাবেচা। এসব দোকানে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লাকড়ির চুলায় রান্না, মাংসের কাটাকুটি, খাওয়া-দাওয়া। ইতিমধ্যে ওসমানি ওরস বিরিয়ানি, আকাশ ওরস বিরিয়ানি হাউস, কর্ণফুলী ওরস বিরিয়ানি, খাজা আজমির ওরস বিরিয়ানির নাম ছড়িয়ে পড়েছে।
ওসমানি ওরস বিরিয়ানির কর্ণধার ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, গত নভেম্বরে তিনি ওরস বিরিয়ানি বিক্রির কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। রোজার শুরু থেকেই ভোজনরসিকের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ ওরসের বিরিয়ানির স্বাদ নিচ্ছেন। এ জন্য কোনো দিন দুটি, কোনো দিন তিন গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে।
ওসমান গণি জানান, ২০ জন বাবুর্চি, সহযোগী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিলে মোট ১০০ জন কাজ করছেন। একসঙ্গে আড়াই শ ব্যক্তি বসে খেতে পারেন। বড় প্লেটের দাম পড়ে ১১০ টাকা, ছোট প্লেট ৬০ টাকা। এ ছাড়া মেজবানি মাংস, গরুর নলাও রয়েছে।
হঠাৎ মানুষ কেন ওরস বিরিয়ানির দিকে ঝুঁকছে, এমন প্রশ্নে ওসমান গণি বলেন, চট্টগ্রামে অনেকগুলো মাজার রয়েছে। ওরসের সঙ্গে এখানকার মানুষ পরিচিত। মাজারে ওরসের সময় তবরুক হিসেবে ওরস বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়। মসলা ও রাঁধার কৌশলের কারণে এটি খেতে অনন্য। মূলত স্বাদের কারণেই এই বিরিয়ানির প্রতি মানুষের আগ্রহ এবার অন্য মাত্রা লাভ করেছে।