সন্তানেরা জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত, আশ্রয়কেন্দ্রে দিশাহারা ফারজানা

সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ফারজানা আক্তার। আজ সকালে ফেনীর ফাজিলপুর জামেয়া ইবনে আব্বাস মাদ্রাসায়জুয়েল শীল

ফারজানা আক্তারের বাড়ি মুহুরী নদীর সঙ্গে লাগোয়া পুর্বালী গ্রামে। ২১ আগস্ট দুপুরের পরপরই তাঁর ঘর ডুবে যায়। তিন সন্তানকে নিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন তিনি। পরের তিন দিন সন্তানদের মুখে কোনো খাবার তুলে দিতে পারেননি।

পানিতে ভিজে ১৩ মাস বয়সী ছেলে মোহাম্মদ আপ্পানের দুদিন ধরে জ্বর। সাড়ে চার বছরের মেয়ে সাদিয়া আক্তারের সর্দি। আশ্রয়কেন্দ্রের চারপাশে বুকসমান পানি হওয়ায় বেরই হতে পারছেন না। চিকিৎসকের পরামর্শও পাচ্ছেন না।

গতকাল সোমবার দুপুরে কথা হচ্ছিল ফারজানা আক্তারের সঙ্গে। জ্বরের চোটে আপ্পান কাহিল। তাকে বুকে জড়িয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের একটি কক্ষের এক কোণে বসে ছিলেন তিনি। তাঁর চোখে–মুখে দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তির ছাপ। অনেকটাই দিশাহারা অবস্থা। কোথায় থাকবেন, পানি কবে নামবে—সেসব নিয়ে মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

কথা বলতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে যাঁরা উঠেছেন, সবাই বিপর্যস্ত। তাঁর দুই ছেলে–মেয়ে অসুস্থ। রাতে ঘুমানোর জায়গা নেই। সন্তানেরা চিড়া, মুড়ি খেতে পারছে না। জামাকাপড়ও নেই।

ফেনী সদরের ফাজিলপুর ইউনিয়নের পূর্বালী গ্রামটি মুহুরী নদীর পানিতে একেবারে তলিয়ে গেছে। গ্রামের কোনো কোনো জায়গায় ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত পানি উঠেছিল। গ্রামের এক প্রান্তে ফারজানাদের বসতঘর। পুরোনো ভাঙাচোরা টিনশেড ঘরটির দুটি কক্ষ বন্যায় ভেঙে পড়েছে।

ফারজানা বলেন, পানি নেমে যাওয়ার পর আরেক যুদ্ধ শুরু হবে। ঘরে গিয়ে সন্তানদের ঘুমাতে দেওয়ার মতো বালিশও নেই। সবকিছুই ডুবে গেছে। আবার নতুন করে কেনার সামর্থ্যও নেই।

আলাপে জানা গেল, ফারজানার স্বামী মো. আমান উল্লাহ পাইপ লাগানোর কাজ করেন। মাসে হাজার দশেক টাকা আয় হয়। কোনো কোনো মাসে কাজ বাড়লে আয়ও বাড়ে। তবে নতুন করে ঘর গোছানোর কোনো পরিস্থিতই তাঁদের নেই।

এই পরিবার স্থানীয় ফাজিলপুর জামেয়া ইবনে আব্বাস মাদ্রাসায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। মুহুরী নদী থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে মাদ্রাসাটির অবস্থান। মাদ্রাসা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ফারজানাদের বাড়ি। মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ ও শিশুরা দুর্বিষহ সময় পার করছে। নিচতলা পুরোপুরি ডুবে থাকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় থাকার জায়গা হয়েছে সবার। অন্তত চার শতাধিক মানুষ থাকছে বলে জানান দুর্গত ব্যক্তিরা। ফারজানা শৌচাগারের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, নারীর সংখ্যা দু শর বেশি। সবাই মিলে একটা শৌচাগার ব্যবহার করতে হচ্ছে। কোনো পানি নেই। বন্যার পানিই ভরসা। পরিস্থিতি খুব খারাপ।

ফারজানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন নার্গিস আক্তার। প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে তিনি স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘কী যে বাজে পরিস্থিতির মইধ্যে দি আমরা যাইয়ের, বলি বুঝাইতাম পাইত্তাম ন।’

আশ্রয়কেন্দ্রে ৯০ বছর বয়সী শরীফা বেগমের দেখা পাওয়া গেল। তিনি হাঁটতে পারেন না। এক মুঠো ভাত পেটে না গেলে শক্তি পান না। ২১ আগস্ট ছেলে তাঁকে কোনোমতে পানির হাত থেকে বাঁচান। শরীফা ভাঙা স্বরে প্রথম আলোকে বলেন, বহু বছর আগে একবার বন্যা হয়েছিল। তখনো এত পানি ওঠেনি। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। তিনি এত পানি কখনো দেখেননি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৮ সালে যে বন্যা হয়েছিল, তখনো এবারের মতো পরিস্থিতি হয়নি। মুহুরী নদী কাছে হওয়ার পরও দোতলা ভবন ডোবেনি। এবার হলো।

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। গ্রামের পর গ্রাম এখনো ডুবে আছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় পানি নেমে গেছে।