চট্টগ্রামে বহুতল ভবনে নামমাত্র অগ্নিনিরাপত্তা

চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন ভবনে নেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি। আবার যেসব ভবনে সিঁড়ি আছে, সেখানে রাখা হয়েছে বিভিন্ন জিনিস। ফলে আগুন কিংবা যেকোনো দুর্ঘটনায় ব্যবহার করা যাবে না এসব সিঁড়ি। গতকাল বেলা একটায় ২ নম্বর গেট এলাকার একটি ভবনেছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের অধিকাংশ বহুতল আবাসিক ভবন ও বিপণিবিতানে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা থাকলেও তা ব্যবহারে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে অনেক ভবনে খোলা হয়েছে খাবারের দোকান বা রেস্তোরাঁ। এসব কারণে ভবনগুলোতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যুর পর বন্দরনগর চট্টগ্রামের বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অবশ্য সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যবস্থা নিতে চাইলেও প্রভাবশালী মহলের চাপের কারণে পিছিয়ে আসতে হয়।

নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। অগ্নিনিরাপত্তায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮-এ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নকশা অনুমোদন দিয়েই দায় সারে সংস্থাটি। নকশা অনুযায়ী ভবন হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের কাজটি ঠিকমতো করে না সিডিএ।

অন্যদিকে ছয়তলার ওপর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, ভবনগুলোতে বিকল্প সিঁড়ি থাকতে হবে। থাকতে হবে জরুরি বহির্গমন পথ। পর্যাপ্ত ও কার্যকর অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, আলো-বাতাস প্রবাহের পরিসর। সব ইমারতে জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিক চিহ্ন থাকতে হবে। ২০ মিটার বা এর বেশি উচ্চতায় এক বা একাধিক তলা আছে এমন ভবনে অগ্নি নিরাপদ সিঁড়ি থাকতে হবে। জরুরি বহির্গমন পথকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। অপ্রতুল সুবিধা থাকলে কর্তৃপক্ষ তা ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেবে।

গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক, ২ নম্বর গেট ও জিইসি মোড় এলাকায় ১০টি বহুতল ভবন সরেজমিন ঘুরে এবং সিডিএ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা দুর্বল। কিছু কিছু ভবনে নামমাত্র ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এতে কোনো কারণে আগুন লাগলে ভবন থেকে মানুষের দ্রুত বেরিয়ে আসা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। ফলে ঢাকার মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।

নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের ২ নম্বর গেট এলাকায় আটতলাবিশিষ্ট ইভস টাওয়ারে কোনো বিকল্প সিঁড়ি নেই। ভবনে একটিমাত্র সিঁড়ি রয়েছে। এই ভবনের দোতলা ও পাঁচতলায় রয়েছে একটি করে রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁর রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে গাড়ি রাখার জায়গায় (গ্যারেজে)।

ভবনের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা মইন উদ্দিন দাবি করেছেন, মালিকপক্ষ সিডিএর নকশা অনুমোদন এবং ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে। তবে বিকল্প বা জরুরি বহির্গমন পথ (ফায়ার এক্সিট) করা হয়নি। এখন এই সিঁড়ি করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

এই ভবনের পাশেই রয়েছে ইয়াকুব ট্রেড সেন্টার। আটতলার এই ভবনে ব্যাংক, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ধরনের অফিস রয়েছে। ভবনটিতেও কোনো বিকল্প সিঁড়ি বা জরুরি বহির্গমন পথ নেই।

একই এলাকায় ১৬ তলার একটি ভবনে দুটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভবনটিতে বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে সিঁড়ির নিচে। এই ভবনে একসময় হাসপাতাল ও বিদ্যালয় ছিল। এখন তা নেই। ভবনের বেশির ভাগ তলা এখনো খালি।

সিডিএর তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫টি। ১০ তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। এসবের মধ্যে কী পরিমাণ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো সংস্থার কাছে নেই।

গত বছর ঢাকার বঙ্গবাজারে আগুনের পর চট্টগ্রামের বিপণিবিতানগুলো নিয়ে জরিপ কার্যক্রম শুরু করেছিল ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় জানানো হয়েছিল, শুধু রেয়াজউদ্দিন বাজারেই ছোট-বড় প্রায় ২০০ বিপণিবিতান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। তালিকা করা হলেও পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রাম নগরে কী পরিমাণ স্থাপনা অগ্নিঝুঁকিতে আছে, তা চিহ্নিত করার কাজ চলমান রয়েছে। যেভাবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকান খোলা হয়েছে, তাতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অধিকাংশ বহুতল ভবন অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা (ফায়ার সেফটি প্ল্যান) মেনে চলে না বলে মন্তব্য করেন সিডিএর প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ কাজী হাসান বিন শামস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বেইলি রোডে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। চট্টগ্রামের যেসব স্থাপনায় জমায়েত বেশি হয়, সেগুলো নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কি না তদন্ত করা হবে। নকশাবহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ করলে এবং অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে নকশা বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।