সিলেটে সরকারি মূর্তাবাগানের জমি দখল করতে খাল খনন, অগ্নিসংযোগ

মূর্তাবাগানে পুকুর তৈরির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে অন্তত আধা কিলোমিটার দীর্ঘ নালা। সে নালায় ঢালা হয়েছে পানিও। ৯ এপ্রিল বিকেলে সিলেট সদর উপজেলার কেওয়াছড়া চা-বাগানেছবি: আনিস মাহমুদ

প্রায় ৩০০ একর জায়গায়জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে মূর্তাবাগান। সম্প্রতি বাগানটির স্থানে স্থানে আগুন ধরিয়ে কয়েক হাজার মূর্তাগাছ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া স্থানের একটি অংশে পুকুর বানাতে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে লম্বা নালা। সে নালায় ঢালা হয়েছে পানিও। কিছু অংশে আবার ধানি জমি তৈরির প্রস্তুতিও চলছে।

সিলেট সদর উপজেলার কেওয়াছড়া চা-বাগানের আওতাধীন জায়গায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) অধীন থাকা লাক্কাতুরা চা-বাগানের ফাঁড়ি বাগান এটি। বাগানের জায়গা দখল করে নিজেদের কবজায় নিয়ে পুকুর ও ধানি জমি তৈরির এমন অভিযোগ উঠেছে বিএনপির দুজন নেতার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হচ্ছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. কছির উদ্দিন ও খাদিমনগর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি সুরমান আলী। তবে এই দুই নেতা বাগানের জায়গা দখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।

মূর্তার বেত শীতলপাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল। এ ছাড়া মূর্তার বেতের ভেতরের নরম অংশ দিয়ে মণ্ড বা পাল্প তৈরি করা হয়।

৯ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা গেছে, টিলাপাড়া আর টুকেরগাঁও গ্রামের মাঝামাঝি অংশে মূর্তাবাগানটি অবস্থিত। বাগানের পাশেই একটি মরা গাং। এর ঠিক পাশে চেঙেরখাল নদী। কয়েক শ একরের বাগানটির অন্তত ১৫টি স্থানে আগুন লাগিয়ে কয়েক হাজার মূর্তাগাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া টিলাপাড়া হয়ে যে রাস্তাটি বাগানে চলে গেছে, এর শুরুর দিকে অন্তত আধা কিলোমিটার অংশের মূর্তাবাগান পুড়ে মাটি খুঁড়ে দীর্ঘ নালা তৈরি করা হয়েছে। পুকুর প্রস্তুতের জন্য নালাটি এক্সকাভেটর দিয়ে খনন করা হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাগানের যেসব স্থানে মূর্তাগাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে মূলত ধানি জমি আর খেত তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে দখলদারদের। এরই মধ্যে বাগানের পাশের কিছু ধানি জমির পাশের মূর্তাগাছ পুড়িয়ে ফেলে পাশের ধানি জমির মতো করে বাগানের জায়গাটিকে রূপান্তরের জন্য বেষ্টনী দিয়ে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে যে পুকুরটি খনন করা হয়েছে, সেখানেও পানি ঢেলে পুকুরে রূপ দেওয়া হচ্ছে।

থানায় অভিযোগ বাগান কর্তৃপক্ষের

বাগানের জায়গা দখলের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে লাক্কাতুরা চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জায়গা দখলের প্রচেষ্টার তথ্য নিশ্চিত করেন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া পাঁচটার দিকে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’

এরপর মঙ্গলবার রাতেই সিলেট মহানগরের বিমানবন্দর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন লাক্কাতুরা চা-বাগানের উপব্যবস্থাপক সৈয়দ তানজিদ রুবাইয়াত। এতে এক্সকাভেটর চালক মুরাদ মিয়ার (৩৭) নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার–পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন সৈয়দ তানজিদ রুবাইয়াত।

মূর্তাবাগানের স্থানে স্থানে আগুন দিয়ে গাছ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৯ এপ্রিল সিলেট সদর উপজেলার কেওয়াছড়া চা-বাগানে
ছবি: প্রথম আলো

লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ২৫ মার্চ সকাল সাড়ে আটটার দিকে মূর্তাজঙ্গল এলাকায় বাগানের জায়গা পরিদর্শনকালে এক্সকাভেটর দিয়ে কিছু লোককে মাটি কাটতে দেখেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে চার–পাঁচজন আসামি দৌড়ে পালিয়ে যান। এ সময় তাঁরা মুরাদ মিয়াকে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটতে দেখেন। তিনি ১৫০ ফুট লম্বা, ৫ থেকে ৬ ফুট প্রস্থ এবং ৪ থেকে ৫ ফুট গভীর মাটি খনন করে খালের মতো রূপান্তর করে প্রায় তিন লাখ টাকার ক্ষতি করেন। এ ছাড়া তিন থেকে চার একর জায়গায় মূর্তায় আগুন ধরিয়ে মূর্তাবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির

স্থানীয় ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা অভিযোগ করেন, গত রমজান মাসে সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. কছির উদ্দিন ও খাদিমনগর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি সুরমান আলীর নেতৃত্বে পুকুর খনন করে মূর্তাবাগান দখলের চেষ্টা শুরু হয়। এসব জায়গা তাঁরা কবজায় নিতে মূর্তাবাগানের বিভিন্ন স্থানে অন্তত কয়েক একর অংশ পুড়িয়েও দেয়। এক্সকাভেটর দিয়ে কিছু অংশে পুকুরও খনন করা হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কছির উদ্দিন ও সুরমান আলী তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁরা দাবি করেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে। তাঁরা কোম্পানির (চা-বাগানের) কোনো জায়গার দখল নেননি এবং একটি মূর্তাগাছও নষ্ট করেননি। বোরহান উদ্দিন নামে বাগানের এক কর্মচারী বাগানের অনেক জায়গার দখল নেন এবং মাটি কেটে বিক্রি করেন বলে তাঁরা উল্টো অভিযোগ করেন।

কছির উদ্দিন বলেন, ‘আমার জায়গাই মানুষের অভাবে (চাষাবাদ) করতে পারি না। আমরা তো দূরের কথা, এলাকার একজন মানুষও কোম্পানির এক ডেসিমেল জায়গা ভোগ করে না। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়; বরং কোম্পানির বোরহান (কেওয়াছড়া বাগানে চৌকিদার হিসেবে কর্মরত) দেড় মাস আগে টিলা কেটে আড়াই লাখ টাকার মাটি বিক্রি করে। বোরহানের পরিবার এবং শহরের এক ব্যক্তির দখলে অনেক জায়গা আছে।’

সুরমান আলী দাবি করেন, মূর্তাবাগানের ভেতরে কে বা কারা মাটি খনন করেছেন, সেটি তাঁর জানা নেই। তবে এটা ঠিক, স্থানীয় অনেক ব্যক্তি চা-বাগানের জায়গা দখল করেছেন। তবে তিনি করেননি।

অভিযোগের বিষয়ে বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত রমজান মাসে কে বা কারা মাটি খনন করেছেন, সেটা সচক্ষে দেখেননি। তবে যে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হয়েছে, এর চালককে তাঁরা শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ওই চালক কছির ও সুরমানের নির্দেশে মাটি কেটেছেন বলে জানিয়েছেন। আর তাঁর (বোরহান) বিরুদ্ধে বাগানের জায়গা দখলের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেটি একেবারেই মিথ্যা। বাগানের কোনো জায়গা তাঁর দখলে নেই।

যোগাযোগ করলে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, অভিযুক্ত দুই বিএনপি নেতার সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। সত্যতা পেলে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূর্তাবাগানের অংশবিশেষের দখল নিয়ে পুকুর ও ধানি জমি তৈরির প্রচেষ্টা স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুততার সঙ্গে থামানো উচিত। অভিযুক্ত বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিক। বাগানের পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনষ্ট করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া প্রয়োজন।’