ফোনের অপর প্রান্তে হঠাৎ গুলির বিকট শব্দ, এরপর সব স্তব্ধ

ছেলে রাফিকে কোলে নিয়ে ফয়েজের এ ছবিটি এখন শুধুই ছবিসংগৃহীত

১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় পাড়ি জমান মো. ফয়েজ। সে থেকেই স্যানিটারি মিস্ত্রির (পাইপ ফিটার) কাজ করতেন তিনি। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের খবর পেয়ে ছেলে মো. ফয়েজকে (৩২) কল দেন তাঁর মা সবুরা বেগম। এ সময় ছেলে বললেন, ‘অনবরত গুলি হচ্ছে। আমি কাজ শেষ করে বের হয়েছি। মা, এখন ফোন রাখো।’ কথার একপর্যায়ে হঠাৎ গুলির বিকট শব্দ পান মা। এরপর সব স্তব্ধ। ছেলের আর কোনো কথা শুনতে পাননি তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২১ জুলাই রোববার সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মো. ফয়েজ। আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিলের ঝাউডগী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি।

গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে হাসপাতালে নিয়েছিলেন তাঁর পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম। আজ রোববার মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, চাঁদা তুলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তিনি আহত মো. ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মাথায় ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁর লাশ লক্ষ্মীপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঠিকাদার কাশেম আরও বলেন, ফয়েজ তাঁর সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করছিলেন। দিনে ৭০০ টাকা মজুরি পেতেন। সামান্য এই আয় দিয়ে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া থাকতেন। ২১ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সাইনবোর্ড এলাকার একটি ভবনে কাজ শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

স্বামী ফয়েজের পর নুর নাহার ও তাঁর ১৮ মাস বয়সী ছেলে রাফি মাহমুদের ঠাঁই মিলেছে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর এক স্বজনের বাসায়। আজ মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে নুর নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামী আমার আশ্রয়, সম্বল সবকিছু ছিল। তাকে তারা গুলি করে মারল। কোন দোষে মারল তাকে, কে জবাব দেবে?’

ঘটনার সাত দিন পেরিয়ে গেলেও কান্না থামেনি ফয়েজের মা সবুরা বেগমের। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘গুলি করে ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলে তো আর ফিরে আসবে না। ওর বউ আর ছেলেকে দেখব কে?’

গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত মো. ফয়েজ
সংগৃহীত

গতকাল শনিবার ফয়েজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশেই তাঁর চিরনিদ্রার জায়গা। সেখানে এক এক করে আসছেন স্বজনেরা। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন অনেকে।

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুটি গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব? আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে আমি চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম।’