জামালপুরে ‘পাওনা টাকা চাইতে গেলে’ চোর অপবাদ দিয়ে রাজমিস্ত্রিকে নির্যাতন
জামালপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে চুরির অপবাদ দিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে এক রাজমিস্ত্রিকে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ শুক্রবার সকাল থেকে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নজরে আসে।
নির্যাতনের শিকার যুবকের নাম মো. মামুন (৩০)। তিনি শাহবাজপুর ইউনিয়নের গণেশপুর এলাকার আবদুল হাকিমের ছেলে। তিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। গত বুধবার রাতে শাহবাজপুর পূর্ব পাড়া এলাকার হাসমত তালুকদারের বাড়িতে তাঁকে বেদম পেটানো হয়। গুরুতর আহত মামুনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ দুজনকে আটক করেছে। তাঁরা হলেন মো. ইলিয়াস (২৫) ও মো. মিজানুর রহমান। তাঁদের দুজনের বাড়ি শাহবাজপুর পূর্ব পাড়া এলাকায়।
নির্যাতনের ২ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। এতে দেখা গেছে, পাকা ঘরের মধ্যে একটি বিছানার ওপর খালি গায়ের এক যুবক। প্রথমে তিন ব্যক্তি তাঁকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। এ সময় যুবকটি হাত দিয়ে লাঠির আঘাত ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন। তখন হাতেই লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিল। তাঁর পায়ের তলায় পেটানো হচ্ছিল। তারপর যুবকটিকে বিছানায় শুইয়ে পেটানো হয়। এরপর আরও দুজন পেটানোতে অংশ নেন। একপর্যায়ে যুবকটি বিছানা থেকে নিচে পড়ে যান। এরপর পাঁচজন এক সঙ্গে মেঝেতে ফেলে তাঁকে পেটাচ্ছিলেন। আশপাশে আরও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউ একজন এটি মুঠোফোনে ধারণ করেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজমিস্ত্রি মো. মামুন ওই এলাকার হাসমত তালুকদারের বাড়িতে নির্মাণকাজ করেন। হাসমতের কাছে কাজের টাকা পেতেন মামুন। বুধবার সন্ধ্যার দিকে তাঁকে টাকা দেওয়ার কথা বলে ওই বাড়িতে ডেকে নেওয়া হয়। টাকা নিয়ে প্রথমে দুজনের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে হাসমত, তাঁর স্বজন এবং প্রতিবেশীরা রাজমিস্ত্রি মামুনকে চোর অপবাদ দিয়ে মারধর করতে থাকেন। পরে তাঁকে একটি ঘরের ভেতরে নিয়ে ব্যাপক পেটানো হয়।
নির্যাতনের শিকার মামুনের প্রতিবেশী তাহের আলী বলেন, ‘নাতিকে চোর অপবাদ দিয়ে বাড়িতে আটকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। শুধু পেটানো হয়নি। দুই ঠ্যাংয়ের মধ্যে রড ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দুটি ঠ্যাংয়ে শুধু রড ও লাঠির আঘাত। অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে তাকে পিটিয়েছে। পিটানোর সময় নাতিটা বারবার বলছিল, সে চুরি করেনি, কাজের পাওনা টাকা চাইতে আসছে, কিন্তু কেউ শোনেনি। আসলে হাসমত তালুকদারের কাছে টাকা চাওয়ার অপরাধে ইচ্ছা করেই তাকে চোরের অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। পিটানোর ভিডিওটি দেখলেই যে কারও চোখের পানি চলে আসবে। এ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
ঘটনার পর থেকে হাসমত তালুকদারের মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে এবং তিনি বাড়িতেও নেই। ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সদর উপজেলার নারায়ণপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) মনজুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মূলত ওই দুজনের মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে তর্কাতর্কি হয়। এ ঘটনায় ওই বাড়িতে চিৎকার–চেঁচামেচি শুরু হয়। অন্যদিকে ওই এলাকায় সম্প্রতি গরু ও ইজিবাইক চুরি হয়েছিল। পরে স্থানীয় লোকজন মামুনকে চোরের অপবাদ দিয়ে হাসমত তালুকদারের বাড়ির বাইরে মারধর শুরু করেন। পরে তাঁকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে একটি ঘরের মধ্যে তুলেও পেটানো হয়। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে দুজনকে আটক করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ দেওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদেরও ধরার চেষ্টা চলছে।
নির্যাতনের শিকার যুবকের মা মাজেদা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুব গরিব মানুষ। পুলাডার মিস্ত্রির কাজকাম কইরা আমগরে চালায়। আর পুলাডা পাওনা টাকা চাইতে গিয়েছিল। আর আমার পুলাডারে চোরের অপবাদ দিয়ে মাইরে শেষ করছে। সারা গায়ে (শরীর) শুধু আঘাত আর আঘাত। মাইরে মাইরে ঠ্যাং দুটো শেষ কইরা দিছে। পুলাডা এহন খাড়াতে (দাঁড়ানো) পাই না। মানুষ মানুষকে এইভাবে মারতে পারে? আমি বিচার চাই। যাতে আমাদের মতো গরিবরে আর এইভাবে কেউ মিছে অপবাদ না দিয়ে মারে।’