৪৭ বছর আগের বিয়ের ঝাঁপি

নাটোরের লালপুরের ভূঁইয়াপাড়া গ্রামের মাজদার রহমান ও মমতাজ বেগম দম্পতির বিয়ের ঝাঁপি। এখনো ঝাঁপিটি যত্ন করে তুলে রেখেছেন মমতাজ বেগমছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী অঞ্চলে একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘বাড়ি বলে ভেঙে দেখ, বিয়ে বলে জুড়ায় দেখ’। অর্থাৎ একটা বাড়ি ভেঙে গড়তে যেমন ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়, তেমনি বিয়ের আয়োজনেও কত–কী যে জোগাড় করতে হয়, তারও ইয়ত্তা নেই। বিয়েবাড়ির শত আয়োজনের সেই রকম একটি হচ্ছে ‘বিয়ের ঝাঁপি’।

যদিও ইদানীং ঝাঁপি ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু অতীতে গ্রামে গ্রামে আলাদা করে বিয়ের ঝাঁপি তৈরি করে নেওয়া হতো। বেতশিল্পীরা নান্দনিক এই ঝাঁপি তৈরি করে দিতেন। ৪৭ বছর আগের বিয়ের এই রকম একটা ঝাঁপি যত্ন করে তুলে রেখেছেন নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর মহল্লার এক কনে।

তখনকার দিনে বিয়ের রেওয়াজ অনুযায়ী, কনের সঙ্গে এই ঝাঁপি দেওয়া হতো। এতে থাকত মুড়ি-মুড়কি, সন্দেশজাতীয় মিষ্টান্ন। যাঁরা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের লোক অথবা শৌখিন মানুষ, তাঁরা মেয়ের জন্য বেতশিল্পীদের কাছ থেকে সুন্দর করে ঝাঁপি তৈরি করে নিতেন।

কয়েক দিন আগে তিনি পরিষ্কার করার জন্য সেই বিয়ের ঝাঁপি বের করেন। লাল-কালো রং দিয়ে উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের বেতশিল্পী রমণী দাস এই ঝাঁপি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে এই ঝাঁপির দাম নিয়েছিলেন ২৫ টাকা।

এই ঝাঁপি ধরে কনের সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য আলাদা লোক থাকত। তাঁকেই বলা হতো ঝাঁপিধরা। সত্যি সত্যিই তাঁকে শক্ত করে এই ঝাঁপি ধরে রাখতে হতো, কেননা বরযাত্রীর ভেতরে এমন লোক থাকতেন, যাঁরা ফেরার পথে ঝাঁপি খালি করে ফেলতেন। এ জন্য ঝাঁপির আবার তালা–চাবিও বানিয়ে নেওয়া হতো।

লালপুরের এই কনের নাম মমতাজ বেগম। তাঁর বয়স এখন ষাটের ওপরে। তাঁর বাবার বাড়ি একই উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামে। ১৯৭৭ সালে তাঁর বিয়ে হয় উপজেলার ভূঁইয়াপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাজদার রহমানের সঙ্গে। তিনি নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের সিআইসি পদে চাকরি করতেন।

আলাপকালে মমতাজ বেগম স্মরণ করতে পারেন, সুগার মিলের ট্রাকে চড়ে বরযাত্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের দিনে বৃষ্টি হলো। তখনকার দিনে সবই কাঁচা রাস্তা। কাদায় পড়ে গাড়ি আর উঠতে পারল না। পথিমধ্যে লালপুরের রামপাড়া গ্রামে বরযাত্রীসহ রাত যাপন করতে হয়েছিল। সেই বিয়ের ঝাঁপি। এটি বড় স্মৃতিময় জিনিস। তাঁর বিয়েতে ঝাঁপি ধরে এসেছিলেন ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম সরকার। বিয়ের পর কুড়ি বছর পর্যন্ত তাঁরা ভূঁইয়াপাড়া গ্রামেই ছিলেন। এরপর তাঁরা বাড়ি ভেঙে লালপুরের গোপালপুর পৌর এলাকার মধুবাড়ি মহল্লায় নতুন বাড়িতে আসেন। সেই বাড়ি স্থানান্তরের সময়ও সেই ঝাঁপি তিনি হারাননি।

এখনো সেই ঝাঁপির বেতগুলো অবিকল রয়েছে। লাল-কালো রং অনেকটা ফিকে হয়ে এলেও বোঝা যাচ্ছে যে নতুন অবস্থায় ঝাঁপিটির কেমন জৌলুশ ছিল। তালা দেওয়ার শিকলটিও ঠিক তেমনি রয়েছে।

এরই মধ্যে পরিবারে ঘটে গেছে একটি দুর্ঘটনা। ২০২১ সালের আগস্টে করোনায় আক্রান্ত হয়ে স্বামী মাজদার রহমান মারা যান। তাঁদের তিন ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। ছোটটি রাজশাহীতে। ছেলেও বিয়ে করে রাজশাহী শহরে থিতু হয়েছেন। বাড়িতে বলতে গেলে মমতাজ বেগম একাই থাকেন।

কয়েক দিন আগে তিনি পরিষ্কার করার জন্য সেই বিয়ের ঝাঁপি বের করেন। লাল-কালো রং দিয়ে উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের বেতশিল্পী রমণী দাস এই ঝাঁপি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে এই ঝাঁপির দাম নিয়েছিলেন ২৫ টাকা। সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে রমণী খেয়েছিলেন বিয়ের দাওয়াত। এখনো সেই ঝাঁপির বেতগুলো অবিকল রয়েছে। লাল-কালো রং অনেকটা ফিকে হয়ে এলেও বোঝা যাচ্ছে যে নতুন অবস্থায় ঝাঁপিটির কেমন জৌলুশ ছিল। তালা দেওয়ার শিকলটিও ঠিক তেমনি রয়েছে। মমতাজ বেগম বললেন, ঝাঁপির বেতগুলো মজবুত আছে। আবার রং করলে ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে। এ জন্য তিনি রংমিস্ত্রিকে খবর দিয়েছেন।

মেয়েপক্ষ থেকেও ঝাঁপি পাঠানো হয়, একইভাবে ছেলেপক্ষ থেকেও ঝাঁপি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। আসলে বিয়ের ঝাঁপি ছিল দুটি নতুন পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একটি সেতুবন্ধ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেই বেতশিল্পী রমণী দাস কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর ভাই সম্পর্কের একজন বেতশিল্পী বিশ্বনাথ দাস এখনো গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেতের সামগ্রী বিক্রি করে বেড়ান। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, আগের লোকজন শখ করে মেয়ের বিয়ের জন্য ফরমাশ দিয়ে ঝাঁপি বানিয়ে নিতেন। এখন বেতের কাজই কমে গেছে। এখন আর কেউ বিয়ের ঝাঁপি তৈরি করে নেন না। সর্বশেষ বিদিরপুর গ্রামের শুকুরউল্লাহ শখ করে তাঁর মেয়ের বিয়েতে ঝাঁপি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেটাও এখন থেকে প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা।

হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ২০০৬ সালে তাঁর মেয়ের বিয়েতে ঝাঁপি পাঠিয়েছিলেন। তার আগে তাঁর বোনের বিয়ের সময়ও ঝাঁপি পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ অঞ্চলের বিয়ের সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন জিনিসসহ ঝাঁপি পাঠানো। মেয়েপক্ষ থেকেও ঝাঁপি পাঠানো হয়, একইভাবে ছেলেপক্ষ থেকেও ঝাঁপি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। আসলে বিয়ের ঝাঁপি ছিল দুটি নতুন পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একটি সেতুবন্ধ।