কক্সবাজারের টেকনাফের গহিন পাহাড়ে ৪ জানুয়ারি শাবকের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় একটি মা হাতি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া হস্তীশাবকটি উদ্ধার করে বন বিভাগ। উদ্ধার হওয়া সেই হস্তীশাবকটি এখন কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে লালনপালন করা হচ্ছে। একইভাবে সাফারি পার্কটিতে মানুষের স্নেহে বড় হচ্ছে আরও দুটি হস্তীশাবক। ওই দুটি হস্তীশাবককে এর আগে উদ্ধার করে সাফারি পার্কে আনা হয়।
টেকনাফ থেকে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া হস্তীশাবকটির নাম রাখা হয়নি। তবে অন্য দুটি শাবকের মধ্যে একটির নাম রাখা হয়েছে বীর বাহাদুর। অপরটির নাম দেওয়া হয়েছে যমুনা। চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ এসব নাম রেখেছে।
৪ জানুয়ারি উদ্ধার হওয়া হস্তীশাবকটি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে আনা হয় পরদিন। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (উখিয়া-টেকনাফ সার্কেল) মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, টেকনাফের পাহাড়ে বাচ্চা প্রসরের সময় মা হাতিটির মৃত্যু হয়েছিল জরায়ু বেরিয়ে আসার কারণে। যন্ত্রণায় ছটফট করে হাতিটির মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। খবর পেয়ে বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে এক দিন বয়সী হস্তীশাবকটি উদ্ধার করে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পাঠান। শাবকটি বর্তমানে সুস্থ আছে। ময়নাতদন্তের পর মা হাতিটি মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের অভ্যন্তরে ৪০ একর গর্জনবনের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে বন্য প্রাণী হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টার। গত বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সম্প্রতি টেকনাফ থেকে উদ্ধার হওয়া হস্তীশাবকটিকে দুধ খাওয়াচ্ছেন মাহুত সুশীল চাকমা (৪৫)। মাঝেমধ্যে হস্তীশাবকটি তাঁকে মাথা দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। শাবকটিকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করছেন মাহুত।
সুশীল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা হারা শাবকটি মায়ের ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল। আমরা তাকে আদর–ভালোবাসায় বড় করার চেষ্টা করছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাবকটিকে অন্তত ১০ বার ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। হাসপাতালের আঙিনায় দিনের বেলায় শাবকটিকে ঘোরানো হয়, রাতের বেলায় আইসোলেশনে রাখা হয়। মশা ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে শাবকটি রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুরুষ হস্তীশাবকটির ওজন এখন ১৩০ কেজি। বর্তমানে শাবকটি সুস্থ আছে। দিন দিন সবল হচ্ছে। নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শাবকটিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
হাসপাতালের আঙিনাতে হস্তীশাবক বীর বাহাদুরকে দেখা গেল দৌড়ঝাঁপ দিতে। পুরুষ শাবকটি ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের বাঁশখালীর জলদী বনাঞ্চল থেকে সংকটাপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করে বনকর্মীরা। বন বিভাগের কর্মীরা জানান, জলদীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলসংলগ্ন বিলের ডোবাতে রাতের বেলায় খাদ্যের সন্ধানে নেমেছিল হাতির পাল। এ সময় ডোবার কাদামাটিতে আটকা পড়ে আড়াই মাস বয়সী শাবকটি। হাতির পাল শাবককে উদ্ধারের চেষ্টা চালায় নানাভাবে। ব্যর্থ হলে শাবকটিকে রেখে হাতিরা বনাঞ্চলে ফিরে যায়। পরে বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাদামাটি সরিয়ে শাবকটি উদ্ধার করেন। শাবকটির বয়স এখন দেড় বছর। ওজন ২৫২ কেজি। শুরুর দিকে শাবকটিকে দৈনিক ১০ বার করে গড়ে ৯০০ গ্রাম ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হতো। এখন ৮ বার দুধের পাশাপাশি খাওয়ানো হচ্ছে ৫০টি কলা, ৬ কেজি শসা, ৫ কেজি মিষ্টিকুমড়া, ১ কেজি গাজর। হাসপাতালের কর্মীরা জানান, আড়াই মাস বয়সী শাবকটি যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন এটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিল। নিবিড় পরিচর্যায় শাবকটিকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে, দিন দিন বড় হচ্ছে। এখন দুধের পাশাপাশি নরম খাদ্য খাওয়ানো হচ্ছে।
যমুনা নামের অপর হস্তীশাবকটির বয়স এখন তিন বছর। তাকে দেখাশোনা করছেন বীরসেন চাকমা নামের আরেক মাহুত। ২০২১ সালের ১০ মার্চ যমুনাকে উদ্ধার করা হয়েছিল টেকনাফের সংরক্ষিত বন থেকে। তখন তার বয়স ছিল চার মাস। প্রসবের কিছুদিন পর বনাঞ্চলের পাহাড় থেকে নিচে ছিটকে পড়ে মারা গিয়েছিল যমুনার মা। এরপর বিপদে পড়ে শাবকটি। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মীরা জঙ্গল থেকে শাবকটি উদ্ধার করে লালনপালনের জন্য পাঠান এই সাফারি পার্কে। সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রথম যখন হস্তীশাবকটি পার্কে আনা হয়েছিল, তখন অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। মুখ ও পায়ে আঘাতের দাগ ছিল, ওজন ছিল ১২১ কেজি। বর্তমানে শাবকটির ওজন ১ হাজার কেজির বেশি। আগে হস্তীশাবককে খাওয়ানো হতো দুধ-দই, কলাগাছ ও সবজি। এখন দৈনিক ৩০ কেজি ঘাস, ৮টি কলাগাছ, ২ কেজি ভুসি, ২ কেজি চালের ঝাউ, ৫ কেজি মিষ্টিকুমড়া, ৩ কেজি শসা খাওয়ানো হচ্ছে।
মাহুত বীরসেন চাকমা (৫৩) বলেন, কিছুদিন ধরে যমুনাকে হাসপাতালের সংরক্ষিত এলাকা থেকে পার্কের উন্মুক্ত জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য হাতিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এত দিনের মানুষের পাওয়া আদর-ভালোবাসা ভুলতে পারছে না যমুনা। মানুষ দেখলেও ছুটে আসে যমুনা, মানুষের সঙ্গে খেলাধুলা করতে চায়।
২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এই সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কের বিভিন্ন বেষ্টনীতে আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজ ধনেশ, কাক ধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙ্গিলা বক, সারস, কাস্তে চরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বন গরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১ প্রাণী।
পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় ৮০ একরের বাঘ–বেষ্টনী। বেষ্টনীতে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে জয়, জুঁই, আঁখি ও বড়ুয়া নামের চারটি বাঘ। সরেজমিনে দেখা যায়, বেশির ভাগ দর্শনার্থীর নজর বাঘের দিকে। বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে কিংবা ছাদে উঠে অনেকে বাঘ দেখেন। দর্শনার্থীরা কাছাকাছি গেলে হুংকার ছেড়ে তেড়ে আসে বাঘ।
পাশেই ৮০ একরের সিংহ–বেষ্টনী। পৃথক দুটি কক্ষের একটিতে আছে সম্রাট নামের একটি পুরুষ সিংহ, অপর কক্ষে আছে দুটি স্ত্রী জাতের সিংহ। দর্শনার্থীরা দূর থেকে সিংহের গর্জন শুনছিলেন। পার্কে দেখা মেলে অজগর, বানর, সাম্বার, চিত্রা হরিণ, ভালুক, জেব্রা, জলহস্তী, উটপাখি ও কুমিরের একাধিক বেষ্টনী। দর্শনার্থীরা প্রাণীদের ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন।
পার্ক বেড়ানোর জন্য রয়েছে একটি এসি ও দুটি নন-এসি বাস। পার্কে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৫ বছরের নিচে) ২০ টাকা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সাফারি পার্ক খোলা থাকে। সপ্তাহে এক দিন (মঙ্গলবার) সাফারি পার্কটি বন্ধ থাকে।