ওরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মেধায় সবাই অনন্য। খেয়ে না খেয়ে থাকলেও পড়াশোনায় এতটুকু ছাড় দেয়নি। তাতে আশাব্যঞ্জক ফলও পেয়েছে। এই চার মেধাবী শিক্ষার্থী এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। খুশির খবরে ওদের ঘরে আনন্দের বদলে এখন দুশ্চিন্তা। ওদের ভর্তি ও পড়ার খরচ নিয়ে চিন্তিত মা-বাবা। এত বাধা ডিঙিয়ে মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর। কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রশাসন ক্যাডারে যোগদানের স্বপ্ন দেখে।
নটর ডেমে রাফসানের ভর্তি অনিশ্চিত
এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তির সুযোগও পেয়েছে ছেলেটি। কিন্তু দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না রাফসানদের পরিবারের। কারণ, রাফসান আহমেদের ভর্তি, পড়া যে অনিশ্চিত। পাঁচ সদস্যের টানাপোড়েনের সংসারে দোকান কর্মচারী বাবা সংসারটা আর চালাতে পারছেন না।
রাফসানের বাড়ি নীলফামারী শহরের সওদাগরপাড়ায়। নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ত সে। সেই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক তাজনুর আফছানা বললেন, ছেলেটা মেধাবী। স্কুলের তহবিল থেকে তাকে সহযোগিতা দেওয়া হতো। তাকে একটু সহযোগিতা দেওয়া গেলে সে আরও ভালো করবে।
রাফসানের বড় দুই ভাই-বোনও উচ্চশিক্ষিত। রাফসান পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু বাবা মোমিনুর ইসলাম (৫৫) ছেলের স্বপ্নপূরণ নিয়ে সন্দিহান। তাঁর ভাষ্য, বড় ছেলেমেয়েরা টিউশনি করে কোনোরকমে নিজেদের লেখাপড়া চালাচ্ছে। তিনি যে বেতন পান, তাতে সংসারই চলে না। ছোট ছেলেকে এখন নটর ডেম কলেজে ভর্তি করাবেন কী দিয়ে!
শিক্ষকদের সহায়তা পেয়েছে আম্বিয়া
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ প্রপার হাইস্কুলের ছাত্রী আম্বিয়া আক্তারও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের বাড়ি গোয়ালন্দের উজানচর ইউনিয়নের শ্রীদামদত্ত পাড়া গ্রামে। মা মলিনা আক্তার গৃহিণী, বাবা আমজাদ হোসেন মাহেন্দ্র চালান।
সম্প্রতি কথা হয় আম্বিয়ার মা মলিনা আক্তারের সঙ্গে। উজানচর শ্রীদাদত্তপাড়া লেকপাড়-সংলগ্ন পাঁচ শতাংশ জমির ওপর তাঁদের একটি টিনের ঘর আছে। মেয়েকে নিয়ে মায়ের অনেক স্বপ্ন। কিন্তু অভাবের সংসারে মেয়ের পড়ার খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। আম্বিয়া ছাড়াও তাঁর আরও এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। আর আম্বিয়া বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনিক ক্যাডারে কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
তার চলার পথে শিক্ষকেরাও সহায়তা করেছেন অনেক। গোয়ালন্দ প্রপার হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ লুৎফর রহমান ও জীবন চক্রবর্তী বলেন, আম্বিয়াকে তাঁরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। শিক্ষকদের বলে প্রাইভেট পড়ার বেতন কমিয়ে দিয়েছেন।
পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লাকির
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় অর্থাভাবে মেয়েটার পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পর লাকির মনোবল বেড়ে যায়। শিক্ষকেরা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তার আশ্বাস দেন। এরপর আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে লাকি ভক্ত। অভাবের সংসারে খেয়ে না-খেয়ে পড়াশোনা করে এবার এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
লাকির বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে। বাবা লক্ষ্মণ ভক্ত কাঠমিস্ত্রি, মা মলীনা ভক্ত দিনমজুরি করেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার মোটামুটি চলছিল। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় জমিজিরাত বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে মেয়ের পড়াও তাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখন মেয়েটার এইচএসসিতে ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁরা।
চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা লাকি সম্পর্কে আগৈলঝাড়া বাহাদুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সত্যরঞ্জন বাড়ৈ বলেন, মেয়েটি মেধাবী। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভবিষ্যতে ভালো করবে।
চিকিৎসক হতে চায় আশা
‘অনেক দিন মেয়েটা না খায়া স্কুল গেইছে। বাড়িত খুব পড়াও পড়ছে। এবার ফলও নাকি খুব ভালো। কিন্তু ওক পড়ার টাকা মুই কোনটে পাইম?’ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বললেন রংপুরের তারাগঞ্জের মুন্সিপাড়া গ্রামের রনজিনা খাতুন। তাঁর মেয়ে আশা মনি এবার চান্দের পুকুর উচ্চবালিকা বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
আশার বাবা আইয়ুব আলী দিনমজুর। তাঁর একার আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসারই চলে না। মেয়ের পড়ার খরচ জুটবে কোত্থেকে! তাই ভালো ফলের পরও আশা মনিদের পরিবারের কারও মুখে হাসি নেই।
আইয়ুব আলী জানালেন, মেয়ের এসএসসির ফরম পূরণের সময়ই ধার করতে হয়েছে। সামনে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাবেন কী দিয়ে—সেই ভাবনাই অস্থির করে তুলেছে। আশা মনিও চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পরিবারটি সম্পর্কে জানেন হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুমারেশ রায়। তিনি জানালেন, মেয়েটা অত্যন্ত মেধাবী। সহায়তা পেলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী; এম রাশেদুল হক, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী; জহুরুল ইসলাম, গৌরনদী, বরিশাল ও রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর]