আশুতোষ বড়ুয়া ও শুক্লা বড়ুয়া দম্পতি ডিসি হিলের সিঁড়িতে বসে আছেন সকাল থেকেই। পরনে বৈশাখের লাল-সাদা নতুন পোশাক। নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন জনশূন্য মঞ্চের দিকে। একেবারে শূন্য বলা যাবে না। ডিসি হিলের স্থায়ী মঞ্চে তখন দু-একজন প্রতিদিনের মতো সকালের ব্যায়াম সারছেন। এই মঞ্চে প্রতিবারের মতো আজ সোমবার সকাল থেকে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। গতকাল রোববার প্রস্তুতি ও সাজসজ্জার সময় ভাঙচুর করা হয় মঞ্চটি।
আশুতোষ বড়ুয়া বললেন, ‘যুগ যুগ ধরে ডিসি হিলের এই উৎসব দেখে বৃদ্ধ হয়েছি। প্রতিদিন ডিসি হিলে হাঁটি। আজ চিন্তা করলাম হাঁটব না। বসে থাকব। প্রতিবছর যেভাবে বসে থাকতাম, সেভাবে বসে আছি। এমন একটি বাঙালি ঐতিহ্যের বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে না দেখে খুব খারাপ লাগছে।’ শুক্লা বড়ুয়া স্বামীর মুখের কথা টেনে বলেন, ‘আমার নাতি-নাতনিদের আজ এখানে থাকার কথা ছিল, সেই সুযোগটা আর হলো না। যারাই কাজটা (ভাঙচুর) করুক, সেটা ভালো হয়নি।’
আজ সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে ডিসি হিলে সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে বর্ষবরণের দিনব্যাপী আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। গতকাল সন্ধ্যায় মঞ্চ ভাঙচুরের পর প্রতিবাদে পরিষদ বর্ষবরণের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। গতকাল রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকজন এই হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। গণমাধ্যমে এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
অনুষ্ঠান হচ্ছে না জেনেও অনেকে ডিসি হিলে নববর্ষের পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে এসেছেন। আবার অনেকে না জেনে চলে আসেন। যেমন বাকলিয়ার জাবেদ। সকাল ৯টায় তাঁর সঙ্গে ডিসি হিলের মূল ফটকের সামনে কথা হয়। জাবেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা পরিবার-পরিজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই ডিসি হিলে আসি। মানুষের একটা প্রাণের মেলা বসে। কত আনন্দ থাকে মানুষের মনে। আজ সেটা হচ্ছে না। বিষয়টা মেনে নেওয়া কঠিন। হামলার প্রতিবাদ জানাই।’
অনুষ্ঠান হবে না সেটা আগেই জানা। তারপরও সকাল থেকে ডিসি হিলের বিভিন্ন প্রবেশমুখে পুলিশের কড়া পাহারা। সাদা পোশাকের পাশাপাশি রয়েছে নারী পুলিশও। আর্চওয়ে বসানো হয় কয়েকটি। দায়িত্বরত পুলিশের উপপরিদর্শক মো. হেদায়েত প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনুষ্ঠান হবে না। তারপরও নিরাপত্তার দায়িত্বে আমাদের থাকতে বলা হয়েছে।’
বেশ কিছু নারী-পুরুষ সকাল থেকেই ডিসি হিলে এসেছেন। উঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে এক দম্পতি ডিসি হিলে আসেন। ফটকে নামতেই তাঁদের চোখেমুখে যেন অবিশ্বাস। তাঁরা জানেন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তারপরও একবার ঘুরে যাচ্ছেন প্রাঙ্গণটি।
ডিসি হিলের বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে প্রতিবছর আশপাশের সড়কে বিভিন্ন পণ্যের মেলা বসে। খাবার, খেলনা, কারুপণ্যসহ কত কী। এবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান না হওয়ায় এই ব্যবসায়ীরা বেশি হতাশ হয়েছেন। কিছু দোকান তারপরও বসেছে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে। ডিসি হিলের মূল ফটকের বাইরে রাস্তায় শরবত বিক্রি করছিলেন মো. সোহেল। তিনি বলেন, আজ অনুষ্ঠান হলে ১০ হাজার টাকার শরবত বিক্রির লক্ষ্য ছিল; কিন্তু হলো না।
বৌদ্ধমন্দিরের মোড়ে সড়কের ওপর খেলনা বিক্রি করছিলেন একজন। তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠান না হওয়ায় আমাদের কপাল খারাপ। মনে করেছিলাম বেচাবিক্রি হবে। সেভাবে জিনিসপত্র কিনেছিলাম।’
সকালে ডিসি হিলে আসেন আঁকিয়ে মো. আলমগীর। তিনি রংতুলিতে মানুষের মুখাবয়ব, কপাল ও হাত রাঙিয়ে দেন নববর্ষের রঙে। তবে লোকজন না দেখে তিনি চলে যান সিআরবি এলাকায়। সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আলমগীর বলেন, ‘ডিসি হিলে গিয়ে ফেরত আসি। এখানে এসে দেখি এখানেও লোকজন একেবারেই কম। ডিসি হিলের ঘটনার প্রভাব পড়েছে। মানুষের মধ্যেও নিজেকে রাঙানোর আগ্রহ নেই। কেউ লিখতে আসছে না—শুভ নববর্ষ।’