নালিতাবাড়ীতে ১১০ বছরের পুরোনো ‘দে মিষ্টান্ন ভান্ডার’

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ‘দে মিষ্টান্ন ভান্ডার’ দোকানের সুস্বাদু রসগোল্লাছবি: প্রথম আলো

গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা ভোগাই নদের দুই পাড়ে গড়ে উঠা ছিমছাম শহর শেরপুরের নালিতাবাড়ী। এই উপজেলা শহরের একটি মিষ্টির দোকানের মিষ্টির সুনাম এ অঞ্চলের সর্বত্র। সবার কাছে ‘দে মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে পরিচিত এই দোকানের রসগোল্লা খুবই সুস্বাদু। এই মিষ্টির বিশেষত্ব হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে ছানা বানিয়ে বানানো হয়। এ ছাড়া আছে চমচম, মন্ডা ও ছানার পায়েস। এখানে ১১০ বছর ধরে ক্রেতাদের কাছে বিশ্বস্ত নাম ‘দে মিষ্টান্ন ভান্ডার’।

ঢাকায় চাকরি করেন উপজেলার সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও ইউনিয়নের রকিব আহমেদ। ছুটি পেলে তিনি বাড়ি আসেন। ঢাকা থেকে সরাসরি পোড়াগাঁও বাস থাকলেও তিনি প্রতিবার নালিতাবাড়ী শহরে আসেন শুধু ‘দে মিষ্টান্ন ভান্ডারে’ মিষ্টি খাওয়ার জন্য। নিজে খেয়ে পরিবারের জন্য নিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এই দোকানের মিষ্টির স্বাদ ও গন্ধে রয়েছে ভিন্নতা। এতে ভেজাল নেই। চোখ বুঝে খেয়ে ফেলা যায়।’

পৌর শহরের তারাগঞ্জ মধ্য বাজারে দোকানটির কোনো সাইনবোর্ড নেই। ভাড়া করা দোচালা একটি টিনের ঘর। সেই পুরোনো ঘরানার দোকানে এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসেন মিষ্টির স্বাদ নিতে। এলাকার বিয়ে ও দাওয়াত খেতে এ দোকানের মিষ্টি নিয়ে যান। এ ছাড়া দূরদূরান্তের লোকজন শখ করে আসেন মিষ্টি খেতে। শহরের অন্যান্য দোকানের তুলনায় তাদের মিষ্টির দাম একটু বেশি। তবে স্বাদে অনন্য হওয়ায় দাম নিয়ে তেমন আপত্তি করেন না ক্রেতারা।

সম্প্রতি ‘দে মিষ্টান ভান্ডার’ দোকানে ঢুকে দেখা গেল, বৃদ্ধ একজন ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছেন। তাঁর নাম অরুণ চন্দ্র দে। তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেছেন। বড় ভাই বিনয় ভূষণ দে মারা গেছেন ২০০১ সালে। দোকানের ভেতরে কাঠের সরু টেবিল। সেখানে চেয়ারে বসে মিষ্টি খেতে দেখা গেল কয়েকজনকে। এর মধ্যে আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক জানান, মিষ্টির স্বাদ নিতে প্রায়ই এখানে আসেন তিনি। তাঁর পাশের টেবিলে বসা এক প্রবীণ বলেন, ‘এই দোকানের রসগোল্লা খাচ্ছি ৪০ বছর ধরে। স্বাদটাই অন্য রকম।’

ক্রেতাদের সামলে ব্যস্ততা শেষে কথা হলো অরুণ দের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবার আমল থেকে আমরা বিশ্বস্ততা ধরে রেখেছি। আমরা প্রতিদিন স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করি। তা দিয়ে নিজস্ব কারিগরেরা ছানা তৈরি করেন। এরপর রসগোল্লা, মন্ডা, চমচম, ছানার পায়েসসহ বিভিন্ন মিষ্টি তৈরি করি।’

এই দোকানে আছে চমচম, মন্ডা, ছানার পায়েসসহ নানা মিষ্টি
ছবি: প্রথম আলো

অরুণ দের বয়স এখন ৭৮ বছর। তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর দুই ছেলে বিপ্লব কুমার দে ও অলক কুমার দে। বাবা-ছেলেরা সময় ভাগ করে দোকানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

আনিসুজ্জামান নামের একজন ক্রেতা এই দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে এসেছেন। কাজের সূত্রে তিনি নারায়নগঞ্জ থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান আছে, এখান থেকে মিষ্টি কিনলাম। মিষ্টি কিনলে এই দোকান থেকেই কিনি, অন্য কোথাও থেকে নয়। যত দোকানের মিষ্টি খেয়েছি, এখানের মতো বিশুদ্ধতার অনুভূতি অন্য কোথাও পাইনি।’

দোকানের মিষ্টির কারিগর আবদুল জলিল ৩০ বছর ধরে এ দোকানে মিষ্টি বানান। ছানা দিয়ে গোল্লা তৈরি করে মাটির চুলায় বড় কড়াইয়ে চিনির শিরাতে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। আরেক কারিগর মোক্তার হোসেন কাঠের চামচ দিয়ে তা নাড়িয়ে দিচ্ছেন। মিষ্টি তৈরিতে তাঁদের সহযোগিতা করেন আরও তিনজন।

প্রতি কেজি রসগোল্লা ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়
ছবি: প্রথম আলো

মিষ্টির দোকান শুরু করেছিলেন অরুণের বাবা শচীন্দ্র দে। তিনি নিজে মিষ্টি বানাতেন। তাঁর বানানো মিষ্টির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সেই সুনাম তিনি ধরে রেখেছিলেন জীবদ্দশায়। পরে ছেলেরা ব্যবসায় যুক্ত হয়ে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। এই দোকানে রসগোল্লার মূল্য আকার ভেদে ২০ ও ২৫ টাকা।

অরুণ দের ছোট ছেলে অলক দে বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন তাঁরা। দিনের মিষ্টি দিনেই বিক্রি হয়ে যায়। তাঁরা প্রতি কেজি রসগোল্লা ২৮০ টাকায় বিক্রি করেন। অরুণের বড় ভাই বিপ্লব দে বলেন, ‘প্রথমে দাদু, পরে জেঠা, এখন বাবা, প্রায় ১১০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন। লাভের চেয়ে সুনাম ও প্রশংসা বেশি থাকায় দাদু, জেঠা ও বাবার এই ব্যবসা আমরা সুনামের সঙ্গে ধরে রাখতে চাই।’