‘মা–বাবাকে জজের মা–বাবা করতে পেরেছি, এটা আমাকে বেশি আনন্দিত করেছে’

হালিমাতুস সাদিয়া
ছবি: সংগৃহীত

বিচারক হতে পেরে আনন্দিত সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হালিমাতুস সাদিয়া। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বেশি আনন্দিত মা–বাবাকে ‘জজের মা–বাবা’ করতে পেরে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই বলেন তিনি।

হালিমাতুস সাদিয়া ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ছোটবেলায় তিনি কী হতে চেয়েছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় কেউ যখন জানতে চাইত জীবনের লক্ষ্য কী? সহপাঠীরা কেউ বলত চিকিৎসক হবে, কেউ বলত প্রকৌশলী হবে। কিন্তু আমি উত্তরে বলতাম, আমি ভিন্ন কিছু হতে চাই। কিন্তু সেই ভিন্ন কিছু কী, সেটা আমি বলতে পারতাম না। এখন আমি বুঝি, ভিন্ন কিছু হওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল আমার এবং অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহর রহমতে আমি সফল হতে পেরেছি। তবে এটা আমার শেষ গন্তব্য নয়, পেশাগত জীবনে সাফল্যের যাত্রা শুরুমাত্র।’

কথা হচ্ছিল হালিমাতুসদের বাবুগঞ্জ উপজেলার লোহালিয়া গ্রামের সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা একতলা বাড়িতে বসে। তাঁর সাফল্যের খবরে বাড়িতে আসছেন স্বজন–প্রতিবেশীরা। এমন সাফল্যের রহস্য জানতে চাইতেই উত্তর এল, ‘নিষ্ঠা, মনোযোগ আর অধ্যবসায়।’ তবে সাফল্যের পথে যাত্রা সহজ ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস হারাতাম, হতাশায় ভুগতাম। কাঁদতাম, আবার পড়াশোনায় ডুবে যেতাম। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। আমি আরও সাহসী হলাম। কান্না মুছে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং মনে মনে বললাম, আমি পারব। শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি—এটাই সত্য। এটা আত্মবিশ্বাস, লেগে থাকা আর অধ্যবসায়ের বিজয়।’

আরও পড়ুন

শৈশব থেকেই হালিমাতুস সাদিয়া মেধাবী। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। তিনি বরিশাল নগরের কাউনিয়া এলাকার একটি মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পরে বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। ২০১৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক এবং ২০১৭ সালে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান। এরপর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১৩তম হন। বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি ভিন্ন কিছু হতে চাও, তবে বিচারক হও।’ বাবার এ কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে স্নাতকে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৮৫ এবং স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৯৩ পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।

হালিমাতুসরা দুই ভাই-বোন। বড় ভাই নাজমুল হক মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে স্নাতক করছেন। বাবা মো. রহমান কবির এলাকায় শাহ্ আলম নামে পরিচিত। তিনি স্থানীয় চাঁদপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কয়েক বছর হলো অবসর নিয়েছেন। মা নাসিমা আক্তার স্থানীয় লাকুটিয়া পিআরসি ইনস্টিটিউশনের (মাধ্যমিক বিদ্যালয়) জ্যেষ্ঠ শিক্ষক।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাড়িতে বাবা–মা–ভাইয়ের সঙ্গে হালিমাতুস সাদিয়া
ছবি: প্রথম আলো

মো. রহমান কবির তাঁর মেয়ের এই সাফল্যে খুব খুশি। বললেন, ‘ও সব সময় চেয়েছে আলাদা কিছু হতে, আমরাও তা–ই চেয়েছি। এখন পেশাগত জীবনেও সাদিয়া আলাদা হোক এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করুক, সেটাই চাই।’

হালিমাতুস সাদিয়া বলেন, এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁর মা–বাবার। রাতে যখন তিনি পড়াশোনা করতেন, তখন তাঁর মা সারা রাত জেগে থাকতেন। বাবা বটবৃক্ষের মতো সারাক্ষণ ছায়া দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন প্রতিটি মুহূর্তে। মা–বাবাকে গর্বিত করতে পেরে তিনি আনন্দিত। তাঁর ভাষায়, ‘জজ হয়ে যতটা না খুশি হয়েছি, তার চেয়ে আমার মা–বাবাকে জজের মা–বাবা করতে পেরেছি, এটা আমাকে বেশি আনন্দিত করেছে। আমি চাই সন্তানেরা তাঁদের মা–বাবাকে এভাবে গর্বিত করুক।’ সফলতার বিষয়ে তাঁর মত, সফল হতে হলে পড়াশোনার ধারাবাকিতা বজায় রাখা দরকার। কে কত ঘণ্টা পড়ল, সেটার চেয়ে বড় বিষয় কী পড়া হলো, সেটা কতটুকু বুঝে পড়া হলো। তিনি কখনো সময় ধরে পড়েননি। কখনো তিনি সকাল আটটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত পড়তেন। এখনো এক ঘণ্টা পড়েছেন।

একজন বিচারক হিসেবে নিজেকে কেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, জানতে চাইলে হালিমাতুস সাদিয়া বলেন, ‘মানুষের বিবেক হচ্ছে বড় আদালত। আমি সব সময় বিবেককে প্রধান্য দেব। সততার সঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকব। আর বিচারে দীর্ঘসূত্রতা আমাদের দেশে অনেক বড় সমস্যা। আমার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা থাকবে এটা লাঘবের। আশা করি, এতেও আমি সফল হব। কারণ, আমরা তো হেরে যেতে পৃথিবীতে আসিনি।’