রথীন্দ্রনাথের গান শোনান তায়েব উদ্দিন, তাঁর গানে মুগ্ধ এলাকার মানুষ

ফসলি মাঠে কৃষিশ্রমিকদের গান শোনাচ্ছেন গায়েন তায়েব উদ্দিন। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বেনুপুর গ্রামেছবি: নূরে আলম সিদ্দিকী

গৃহস্থালির কাজে কিংবা ফসলি জমিতে কাজ করার সময় গলা ছেড়ে গান ধরেন তায়েব উদ্দিন (৬৫)। হাতে কৃষিযন্ত্র আর কণ্ঠে তাঁর বাহারি সুরের গান। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন জমিতে কাজে ব্যস্ত অন্য কৃষিশ্রমিক ও স্থানীয় লোকজন।

তায়েব উদ্দিনের বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ২ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের বেনুপুর গ্রামে। তিনি একই গ্রামের মৃত তাহের উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে। ছোটবেলায় বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত ভাওয়াইয়া ও লোকসংগীত শুনে গানের প্রেমে পড়েন তিনি। পাশাপাশি নিজের মতো করে গানের চর্চা চালিয়ে যান। কোথাও গানের আসর বসলেই ছুটে যেতেন তায়েব। মাঠেঘাটে কিংবা পাড়ার টংদোকানের পাশে গানের আসর বসাতেন তিনি। তাঁর গানের তালিকায় থাকত বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া গান।

রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ৫০-৬০টি গান রপ্ত করেছেন বলে জানান তায়েব উদ্দিন। আর এসব গান তিনি চার দশক ধরে এলাকার ছোট-বড় অনুষ্ঠানে এবং মাঠেঘাটে গেয়ে থাকেন। এলাকায় তিনি ‘গরিবের রথীন্দ্রনাথ’ হিসেবে পরিচিত।

ফসলি মাঠে গান গেয়ে বেড়ান গায়েন তায়েব উদ্দিন। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বেনুপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সংসারের কাজ ও মাঠের কাজের অবসরে গ্রামের রাস্তার মোড়ে বা দোকানের পাশে গানপ্রেমী শ্রোতাদের অনুরোধে গান শোনান তায়েব। স্থানীয় কাটলাবাজারে একটি ক্লাবে সন্ধ্যায় নিয়মিত গানের আড্ডা বসে। তায়েব উদ্দিনের গাওয়া গানগুলোর মধ্যে আছে—‘আমি পাগল হব, পাগল নিব, যাব পাগলের দেশে’, ‘এই মনে আছে মন মহাজন, চোখে দেখা যায় না’, ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিল না আমারে’, ‘আমি কি তোর আপন ছিলাম না’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে’, ‘তুমি আর একবার আসিয়া যাও মোরে কান্দাইয়া’ আর ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’।

গানের টানে এলাকার বিভিন্ন গানের আসরে রাত কাটিয়েছেন তায়েব। তাঁর মনপ্রাণ পড়ে থাকত গানে। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পারেননি। পৈতৃক বসতভিটায় মাটির জরাজীর্ণ ঘরে দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর বসবাস। তাঁর এক মেয়ে স্কুলপড়ুয়া, আরেক মেয়ে কলেজে পড়ে। নিজের সম্পদ হিসেবে কয়েক শতক আবাদি জমি ও শখের একটি দোতারা।

পৈতৃক বসতভিটায় মাটির জরাজীর্ণ ঘরে দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর বসবাস। তাঁর এক মেয়ে স্কুলপড়ুয়া, আরেক মেয়ে কলেজে পড়ে। নিজের সম্পদ হিসেবে কয়েক শতক আবাদি জমি ও শখের একটি দোতারা।

ছোটবেলা থেকে পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ফসলি জমিতে কৃষিকাজের পাশাপাশি গরু চরাতেন তায়েব উদ্দিন। সে সময় মাঠে জমির আলপথে রাখা রেডিওতে ভাওয়াইয়া গান শুনতেন জমির মালিক ও কৃষিশ্রমিকেরা। রেডিওতে গান শুনতে শুনতেই গানের প্রেমে পড়েন। সেই সব গান এখনো গেয়ে চলেছেন তিনি।

সম্প্রতি বেনুপুর গ্রামে গিয়ে পেঁয়াজখেত নিড়ানি দিতে দেখা যায় তায়েবেকে। আর গলা ছেড়ে গাইছিলেন গান—‘কলসি কাঁখে যায় গো কন্যা নদীর পন্থ দিয়া, ফিরা ফিরা চাও কেন কাঁপে যে মোর হিয়া’। গান শেষে আলাপকালে তায়েব উদ্দিন বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি গরু চরাতাম। আর মাঠে আইলে-পাকারে রেডিও থুইয়ে রংপুরের ভাওয়াইয়া শিল্পী রথীন্দ্রনাথের গান শুনতাম। তখন থেকেই আমার তাঁর গান ভালো লাগে।’ শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় সম্পর্কে তায়েব উদ্দিন বলেন, ‘রথীন্দ্রনাথ রায় একজন গুণী শিল্পী। তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য আমার ইচ্ছে করে। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে মনের মধ্যে খুব আনন্দ লাগত।’

নিজের বসতবাড়িতে গায়েন তায়েব উদ্দিন। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বেনুপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গায়েন তায়েব উদ্দিনের প্রতিবেশী ইবনে মুরাদ বলেন, ‘তায়েব ভাই আসলেই খুব সুন্দর গান করেন। ছোটবেলা থেকেই গান শুনে আসছেন। যখন মাঠেঘাটে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন, তখন ওনার গান শুনে তাঁদের প্রাণশক্তি বাড়ে। এলাকাবাসীর চাওয়া, উনি একজন গুণী শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পাক।’

বিরামপুর উপজেলার ২ নম্বর কাটলা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের লোকসংগীত বিভাগের গীতিকার জালাল উদ্দীন রুমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তায়েব উদ্দিন তৃণমূল পর্যায়ের একজন গুণী শিল্পী। তিনি শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের অত্যন্ত ভক্ত। তায়েব উদ্দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের সেরা গানগুলোই মূলত গেয়ে থাকেন। এলাকার সংগীতপ্রেমীরা তায়েব উদ্দিনের গানে শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের সুর খুঁজে পান। তিনি লোকসংগীতও গান। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লোকসংগীতকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের উচিত হবে তায়েব উদ্দিনের কণ্ঠকে সংরক্ষণ করা।’