মাথা তুলতেই গুলি এসে লাগে শাফিলের চোখে-মুখে-কপালে

পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে চোখে গুলি লাগে আবদুল্লাহ শাফিলেরছবি: প্রথম আলো

খুলনায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সড়কে থাকা মাটিকাটার যন্ত্রের পেছনে কয়েকজন লুকিয়েছিলেন। একটু পর পুলিশের অবস্থান দেখতে মাথা তুলেছিলেন আবদুল্লাহ শাফিল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি এসে তাঁর চোখে-মুখে-কপালে এসে লাগে। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শাফিল বললেন, ‘মনে হচ্ছিল চোখে লাগা ছররাটা চোখ চিরে আমার মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করছে। কিছুই আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই টেনে নিয়ে যায় পাশের নর্দমার মধ্যে।’

এ ঘটনা ২ আগস্টের। খুলনা নগরের হরিণটানা থানা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চোখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ হন শাফিল। তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর খুলনা, ঢাকার একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি, কিন্তু এখনো বাঁ চোখে আলো ফেরেনি। ডান চোখে ঝাপসা দেখছেন; যন্ত্রণা তো আছেই।

শাফিলদের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার জিউধারা গ্রামে। তবে থাকেন খুলনা নগরের হাজি ইসমাইল লিংক রোডের ভাড়া বাসায়। তাঁর বাবা ইউনূস আলীর মাছের ঘেরের ব্যবসা রয়েছে। মা মাছুমা আক্তার গৃহিণী। একমাত্র সন্তানের এমন অবস্থায় তাঁদের চোখে ঘুম নেই। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটছেন।

গত শুক্রবার বিকেলে ভাড়া বাসায় গিয়ে শাফিল ও তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। শাফিল বলেন, ‘সবাই একটা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু সেই মুক্তির স্বাদ উপভোগ করতে পারছি না। একটাই চাওয়া, দুচোখ ভরে যেন দেখতে পারি। নিজের পড়াশোনার জগতে যেন ফিরতে পারি। আর যে মানসিক ট্রমার মধ্যে, সেটা থেকে যেন মুক্তি পাই।’

শাফিলের শরীরে এখনো তিনটি গুলি আছে। সিটি স্ক্যানের তথ্যমতে, শাফিলের মাথার পেছনের অংশে, কপালের বাঁ পাশে ও বাঁ চোখের ভেতরে গুলি আছে। চিকিৎসকেরা লিখেছেন, বাঁ চোখের রেটিনা ছুটে আসছে, ভেতরে রক্তপাত আছে, চোখ আলো বুঝতে পারছে না। এ জন্য অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টি কতটুকু ফিরবে বলা যাচ্ছে না।

খুলনার দারুল কুরআন সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল, খুলনা পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শাফিল। কয়েক মাস পর ভর্তি বাতিল করে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শাফিলের টেবিলজুড়ে বিজ্ঞান ও আইইএলটিএস প্রস্তুতির বই। দেশের বাইরে গিয়ে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। চোখে গুলি লাগার পর খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজিতে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।

আরও পড়ুন

শাফিলের মা মাছুমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাক্তারকে বারবার বলেছি আমার চোখটা কোনোভাবে ওকে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু এ রকম নাকি হয় না। ডাক্তার জানিয়েছেন, অপারেশনের মাধ্যমে চোখ থেকে গুলিটা বের করা সম্ভব। তবে দৃষ্টিশক্তি ফেরার বিষয়ে কিছু বলছেন না।’ কথা বলার সময় দুই চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছিল মাছুমার। মায়ের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে শাফিল বলছিলেন, ‘মা তুমি কাঁদলে সহ্য হয় না। কোনো দুর্ঘটনায় তো এমনটা হতে পারত। সেটা তো হয়নি। একটা ভালো কাজের জন্য হয়েছে। এটুকু অন্তত তোমার ভালো লাগার জায়গা।’

ছেলের কথায় মাছুমা কিছুটা শান্ত হলেও দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। বললেন, ‘সব রকম চেষ্টা করছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা দরকার। এই মুহূর্তে ওর চিকিৎসাটা দরকার। এমনও যদি হতো চিকিৎসাটা হতো। আস্তে আস্তে না হয় আমরা টাকাটা শোধ করে দিতাম।’

বিদেশের দুটি হাসপাতালে ই–মেইল করে চিকিৎসার খরচ জানতে চেয়েছিল শাফিলের পরিবার। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, অন্তত ৬০ হাজার ইউএস ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৭৫-৮০ লাখ টাকা) দরকার। একাধিক অস্ত্রোপচার হলে আরও বেশি। শাফিলের পরিবার জমি বিক্রিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাফিল বলেন, ‘খুলনার জিরো পয়েন্টে যে মাটির ওপর বসে সংগ্রাম করলাম, সেখানে আমাদের একখণ্ড জমি আছে। ট্রিটমেন্টের জন্য আমার মা-বাবাকে সেই জমিটাই বেচতে হচ্ছে। তা–ও এ রকম দু-একটা জমি বেচে আমার চিকিৎসার কতটুকুই–বা উঠবে।’

কথায় কথায় অনেক আক্ষেপ করলেন শাফিল। বললেন, ‘দুই দিন পর বাজার মনিটরিং করলে দেশে কী দুর্ভিক্ষ লেগে যেত। রাস্তা পরিষ্কার একদিন পর করলে মানুষ তো মরে যেত না। অনেকে আনন্দ মিছিল করছে, অনেকে ক্ষমতার প্রদর্শন করছে— এগুলো এখন দরকার না। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার। যাঁরা মরার পথে, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া দরকার। আমার অঙ্গহানি না হলেও আমি এমনটাই বলতাম। আমি তো টাকা চাচ্ছি না। আমার একটু চিকিৎসা হোক, এটুকু তো চাইতে পারি। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিচ্ছু পাচ্ছি না।’

আরও পড়ুন

গত ২১ আগস্ট শাফিলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন শাফিল জানান, ‘আমাদের ওয়ার্ডে যতজন চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার মধ্যে আটজনের রেটিনা ইস্যু। এর মধ্যে এক–দুজনের দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না বলে দেয়া হয়েছে, অন্য সবার কমবেশি দৃষ্টিশক্তির উন্নতি হচ্ছে। 

মাত্র দুজনের বিষয়ে চিকিৎসক নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না, তার মধ্যে শাফিল একজন। শাফিল বলেন, ‘এখানকার চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করতে বলেছেন। তবে বাংলাদেশে যেহেতু এ ধরনের অপারেশনের সফলতার হার খুবই কম, তাই আবার মা–বাবা চাচ্ছেন জমিজমা বিক্রি করে হলেও বিদেশে নিতে। সেভাবে প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।’ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার মতো তহবিল সংগ্রহ হয়েছে বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন