জরাজীর্ণ রিকশাই এখন মন্টুর অবলম্বন

জরাজীর্ণ রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন চালক মন্টু। সম্প্রতি রাজশাহী নগরের অলকার মোড় এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী নগরে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য। প্যাডেলচালিত রিকশা আর নেই বললেই চলে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি প্যাডেলচালিত রিকশা। সময় ১৬ জানুয়ারি, রাত ৯টা। স্থান নগরের অলকার মোড়। শীতের রাতে কনকনে ঠান্ডা। বাইরে লোকজন তেমন নেই।

রিকশাটি জরাজীর্ণ; হুড খুলে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। চালকের অবস্থা আরও জীর্ণ। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। গায়ে লাল-সাদা জ্যাকেট, পরনে লুঙ্গি। মাথায় উলের টুপি, গলায় মাফলার। পায়ে দুই ফিতার স্যান্ডেল। ক্লান্ত মুখে চোখ দুটি উজ্জ্বল।

ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি, হাতে ব্যাগ। তাঁকে সম্ভাব্য যাত্রী বিবেচনা করে ওই রিকশাচালক বললেন, ‘ভাই আসেন, সাহেব বাজার, সাহেব বাজার’। তবে ওই ব্যক্তি রিকশায় উঠতে রাজি হলেন না। রিকশাচালক কিছুটা চাপাচাপি করলেন। তখন তাঁর উদ্দেশে ওই ব্যক্তি বললেন, ‘আমি কি আপনাকে বলেছি, আমি সাহেব বাজার যাব। আপনি সাহেব বাজার সাহেব বাজার বলে আমাকে রিকশায় তুলতে যাচ্ছেন কেন?’ রিকশাচালক কোনো জবাব দিলেন না; মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরই ওই ব্যক্তি পাশের একটি অটোরিকশায় চড়ে সাহেব বাজারের দিকে গেলেন।

চালকও সেখান থেকে রিকশা নিয়ে অন্যত্র রওনা হলেন। তখনই এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যান। তবে রিকশাচালক কথা বলতে রাজি হলেন না। সাহেব বাজার যাওয়ার ভাড়া দিতে চাইলেও রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তখন পাশের আরেক রিকশাচালক মধ্যস্থতা করলেন। এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘আরে ভাই, আপনি সাহেব বাজার গেলে যে ভাড়াটা পাবেন, সেটা তো উনি দিতেই চাচ্ছেন। ওনার কথাটা একটু শুনেন না!’  

নাম–পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই রিকশাচালক কেবল এক শব্দে বললেন, ‘মন্টু’। আগে–পিছে কিছু নেই—এমন প্রশ্নে তিনি না–সূচক মাথা ঝাঁকালেন। বয়স জানতে চাইলে প্রথমে বললেন ৭৫ বছর। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাতের আঙুলে হিসাব করতে লাগলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে হিসাব শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে জানালেন, তাঁর ৭৪ বছর। কথায় কথা জানা গেল মন্টুর বাড়ি রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া এলাকায়। পরিবারের সদস্যদের কথা তিনি বলতে চাইলেন না। বললেন, ‘আমি, আমিই।’

জোরাজুরি করার পর মন্টু জনালেন, তাঁর এক বোন আছেন। স্ত্রী–সন্তানদের কথা জানতে চাইলে বললেন, ওরা সব আলাদা থাকে। এখন বোনকে নিয়ে তাঁর সংসার। খাওয়াদাওয়া হোটেলে করেন। দুই বছর ধরে রিকশা চালান। এর আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। শরীরে আগের মতো শক্তি নেই; রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

জরাজীর্ণ রিকশা সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্টু বললেন, রাজশাহী নগরের পঞ্চবটী পুলিশ ফাঁড়িতে রিকশাটা পড়ে ছিল। তিনি এক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন। জরাজীর্ণ রিকশাটি মেরামত করেন না কেন, জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মেরামত করার টাকা হয় না। প্রতিদিন ১০০ টাকার বেশি ভাড়া হয়। আজ (১৬ জানুয়ারি) কত টাকা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘ওই ১০০ টাকাই হয়েছে।’  

কথা বলার বিনিময়ে টাকা দিতে চাইলেও প্রথমে মন্টু রাজি হলেন না। একপর্যায়ে টাকাটা নিলেন। ৫০ টাকার ওই নোটের দিকে তিনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।