বাবা ছিলেন ভাঙারি বিক্রেতা, খুনের আসামি ছেলে দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী
সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশি আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান খোলা এবং তাঁর আয়েশি চালচলনে অবাক তাঁর গ্রামের স্বজনেরা। বিষয়টি তাঁদের কাছে রহস্যের মতো লাগছে। আরাভ খানকে তাঁরা চেনেন সোহাগ, রবিউল, আপন ও হৃদিক নামে। আরাভ খানের বাবা ভাঙাড়ির ব্যবসা করতেন। তাঁর পাঁচ চাচার সংসার চলে টেনেটুনে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন ইউনিয়নের আশুতিয়া গ্রামে আরাভের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তাঁর বাবা মতিউর রহমান মোল্লা ছোটবেলা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে ভাঙাড়ি মালামাল কেনাবেচা করতেন। তিনি বিয়ে করেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার মুলাদী গ্রামে। সেখানেই স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে থাকতেন মতিউর। দুই মেয়ে শারমিন ও নাজনীনকে বিয়ে দিয়েছেন বাগেরহাটেই। সন্তানদের মধ্যে আরাভ সবার ছোট। ১০ বছর আগে কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন ইউনিয়নের আশুতিয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে ঘর নির্মাণ করেন মতিউর। এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আরাভের গ্রামের বাড়ি গেলে দেখা যায়, তাঁদের ঘরটি মাঝারি আকারের, পাকা দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি। ঘর তালাবদ্ধ। পরে কথা হয় আরাভের চাচি, চাচাতো ভাইসহ পাঁচ স্বজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, আজ ও গতকাল আরও চার-পাঁচজন লোক এসেছিলেন আরাভের খোঁজ নিতে। সবাই জানতে চান আরাভ এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন? তাঁরা জানান, এ বিষয়ে তাঁদের কিছুই জানা নেই।
কথায় কথায় জানা যায়, গ্রামের বাড়িতে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর যাতায়াত ছিল আরাভের। ওই সময়টায় মাঝেমধ্যে বাড়িতে যেতেন তিনি। দু–এক দিন থেকে আবার চলে আসতেন। তাঁর উত্থান এলাকার কেউ জানতেন না। এমনকি তিনি কোথায় কী করছেন, কোথায় থাকেন, তা–ও জানতেন না। তবে আপনজনদের কেউ যদি যোগাযোগ করতেন বা কোনো সাহায্য চাইতেন, তাহলে কাউকে নিরাশ করতেন না আরাভ।
আরাভের বড় চাচা হায়দার আলী মোল্লার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির লোক রবিউলকে সোহাগ নামে জানেন। তার মামাবাড়ির লোক তাকে রবিউল নামে ডাকে। লোকমুখে আরাভ নামটা গতকালই শুনতে পেলাম। ছোটবেলা থেকেই সে মামাবাড়িতে বেড়ে ওঠে। বাড়িতে তেমন একটা না আসায় সবাই তাকে ভালোভাবে চেনেও না।’
মনোয়ারার দাবি, সোহাগ তথা আরাভ ব্যক্তি হিসেবে ভালো মানুষ। ঢাকায় থাকতে এলাকার অনেক লোক তাঁর কাছ থেকে উপকার পেয়েছে। গ্রামের কোনো মানুষ তাঁর নামে বাজে কথা বলতে পারবে না। ঢাকায় তিনি হৃদিক নামে পরিচিত।
তিনি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে সৌদিতে থাকে। তারা বিদেশ যাওয়ার সময় সোহাগের (আরাভ) কাছে টাকা চেয়েছিলাম। সে আমাদের ৩ লাখ টাকা দিয়েছিল। আমার ছেলেরা পরে তার টাকা শোধ করে দেয়। তবে রোজা বা কোরবানির ঈদের সময় এলাকায় অনেক লোককে কাপড় দেয় সে। কোরবানির সময় দুই-তিনটা গরু কোরবানি দেয়। তবে সে বাড়িতে আসে না।’
আরাভের অনেক ধনসম্পদ থাকার খবরে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বলে জানালেন মনোয়ারা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মাছ বিক্রি করেন। আজ সকালে বাজারে মাছ বিক্রি করতে গেলে বাজারের লোক তাকে ওই বাজারে মাছ বিক্রি করতে দেননি। তারা বলে, “তোমার ভাতিজা হাজার কোটি টাকার মালিক, তুমি কেন মাছ বিক্রি করবা।” আমরা আসলে জানি না যে সে এত টাকার মালিক।’
গতকাল বুধবার রাতে দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরও বেশ কয়েকজন তারকা। আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম আরাভ খান। বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, ওই আরাভ খানই প্রকৃতপক্ষে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রবিউল ইসলাম। চার বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময়ের ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
স্বজনেরা জানান, দেশে আরাভের স্বপ্ন মোল্লা নামে একটি ছেলেসন্তান আছে। কিন্তু কোথায় তিনি বিয়ে করেছেন, তা জানা যায়নি। ওই সন্তান দাদা–দাদি লালন–পালন করেন। আরাভের চাচাতো ভাই ফেরদাউস মোল্লা বলেন, এক সপ্তাহ আগে আরাভ বাবা মতিউর রহমান, মা লাকি বেগম, বোন শারমিন আক্তার ও ছেলে স্বপ্ন মোল্লাকে দুবাইয়ে নিয়ে যান। মতিউর রহমান মোল্লা ভাঙারি ব্যবসা করতেন। পাঁচ বছর হলো তিনি কোনো কাজ করেন না।
ফেরদাউস আরও বলেন, ‘আমার সঙ্গে সোহাগের (আরাভের) দেখা হয়েছিল ঢাকাতে। সে আমাকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে চেয়েছিল, আমি তার প্রস্তাবে রাজি হইনি। সোহাগ নাকি দুবাইতে অনেক বড় দোকান করেছে। তার বিরুদ্ধে নাকি মামলা আছে। আজ লোকমুখে জানতে পারলাম। সে এত টাকার মালিক কীভাবে হলো, তা আমাদের জানা নেই। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস হয় না, সে এত টাকার মালিক। তবে তাঁর একাধিক বিয়ে আছে।’
দুবাইয়ে আরাভ খানের এত ধনসম্পদ থাকার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আশুতিয়া গ্রামের জুলহাস মোল্লা। তিনি বলেন, ‘সোহাগ মোল্লা কীভাবে হয়ে গেলেন আরাভ খান! আরাভের বাবা সামান্য একজন ভাঙারি ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর ছেলে কীভাবে এত টাকার মালিক হতে পারে? বাড়িতে সামান্য ঘর ছাড়া অন্য কোনো জায়গাজমিন ছিল না তাদের।’