মৌলভীবাজার শহরে নতুন অতিথি ‘রুদ্রপলাশ’
পুকুরের চার পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন উচ্চতার নানা ধরনের গাছ। এসব গাছ পুকুরকে ঘিরে এক আরণ্যক মায়া তৈরি করেছে। সূর্য এদিক-ওদিক হেলে পড়লে গাছের ছায়া পড়ছে পুকুরের শান্ত জলে। নারকেল ছাড়া অন্য যত ছোট-মাঝারি আকারের গাছ আছে, তার প্রায় সব কটিই ফুলের গাছ। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছে ফুল ফুটছে।
এসব গাছ বেড়ে উঠেছে মৌলভীবাজার পৌরসভা কার্যালয় প্রাঙ্গণের পুকুরপাড়ে। শহরকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা, রাঙিয়ে তোলার অংশ হিসেবে পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এসব গাছ লাগানো হয়েছে। এখন বসন্তকাল। গাছে গাছে ফাল্গুনের হওয়া, ফাল্গুন প্রকৃতি। শাখা-প্রশাখায় নতুন ফুল ও পাতা এসেছে। এ রকম বসন্ত প্রকৃতিতে পুকুরপাড়ে গাছের ভিড়ে অগ্নিশিখার মতো ফুটেছে ‘রুদ্রপলাশ’। রুদ্রপলাশ এই শহরে নতুন অতিথি। পৌর প্রাঙ্গণের সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে এখন দেখা মিলছে এ ফুলের।
এ অঞ্চলে পলাশ ফুলেরই খুব একটা দেখা পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে রুদ্রপলাশ আরও দুর্লভ একটি গাছ। অন্য সব ফুলের সঙ্গে মৌলভীবাজার পৌরসভার পুকুরপাড়ে এ রুদ্রপলাশের গাছ লাগানো হয়েছে বছর তিন-চার আগে। এর আগে চোখের আড়ালে দু-একটি ফুল ফুটলেও এবারই প্রথম রুদ্রপলাশ অনেকটা আপন চেহারা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। মৌলভীবাজারের কানাডাপ্রবাসী ফুলপ্রেমিক নুরুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, গত বছর এই একই গাছে একটি ফুল ফুটতে তিনি দেখেছিলেন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের পূর্ব দিকে রুদ্রপলাশের গাছে বেশ কিছু ফুল ফুটেছে। কিছুদিন আগে এই ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। গাছটির একেবারের চূড়ার দিকের একটি ডালে একটিমাত্র ফুল ফুটতে দেখা গেছে। ধীরে ধীরে ফুলটি পাপড়ি মেলে অগ্নিশিখার মতো লাল থোকা হয়ে এখন জ্বলে উঠেছে। এরপর পর্যায়ক্রমে কয়েকটি ডালে আরও কয়েকটি রুদ্রপলাশের ফুল ফুটেছে। গাছের চূড়ার ডালে ডালে, সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুলগুলো জ্বলজ্বল করছে।
গতকাল শনিবার সকালে দেখা গেছে, রোদে ফুলগুলো জ্বলন্ত মশালের শিখার মতো লাগছে। দূর থেকে হঠাৎ মনে হয়, সবুজের ভেতর বিক্ষিপ্ত কিছু অগ্নিশিখা অবিরাম জ্বলছে। বেশকিছু নতুন কুঁড়িও দেখা গেছে কয়েকটি ডালে। এরাও যেকোনো মুহূর্তে ফুটবে। রুদ্রপলাশ পাখিদের একটি পছন্দের ফুল। একটি বুলবুলি সেই ফুলে এসে বসছে, এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ছুটছে।
‘রুদ্রপলাশ’ নামটি প্রয়াত নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার দেওয়া। দেশ-বিদেশে খ্যাতিমান এই নিসর্গপ্রেমীর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। রুদ্রপলাশ ছাড়াও এই ফুলের আরও কিছু নাম আছে। এর মধ্যে অন্যতম পরিচিত নাম হচ্ছে আফ্রিকান টিউলিপ। এ ছাড়া ফ্লেম অব দ্য ফরেস্ট, ফাউন্টেন ট্রি, উগান্ডা ফ্লেম—এ রকম কিছু নাম। এই ফুলের আদি নিবাস আফ্রিকা অঞ্চলে, তাই এর নাম আফ্রিকান টিউলিপ। তবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি, কোস্টারিকা ও শ্রীলঙ্কায় এই ফুলের দেখা মেলে।
ফুলটির নাম রুদ্রপলাশ হলেও এটি পরিচিত পলাশ ফুল নয়। রুদ্রপলাশ একটি চিরসবুজ গাছ। রুদ্রপলাশের গাছ সাধারণত ২৫ থেকে ৮০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। বসন্তের শুরুতে গাছের চূড়ায় রাশিরাশি ফুল ফুটতে থাকে। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উজ্জ্বল লাল রঙের রুদ্রপলাশ চোখ কাড়ে, প্রকৃতিকে লাল-সবুজে সাজিয়ে তোলে। রুদ্রপলাশ ফুলের কুঁড়ি দেখতে অনেকটা পলাশ ফুলের কুঁড়ির মতোই। গাছের ডালের একেবারে চূড়ায় গোলাকার মঞ্জরিতে ফুল আসে। ওই মঞ্জরির সব কুঁড়ি একসঙ্গে ফোটে না। ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে আস্তেধীরে উজ্জ্বল লাল রঙের রুদ্রপলাশ ফোটে। ফুলের ভেতরের অংশ লালচে সোনালি আর পাপড়ির কিনারা কোঁকড়ানো। ফুল ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৫ সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে থাকে। পাপড়ি থাকে পাঁচটি। পাপড়িগুলো একসঙ্গে যুক্ত থাকে। গাছের বয়স তিন থেকে চার বছর হলেই ফুল ধরতে শুরু করে।
রুদ্রপলাশের ফুল ফোটার পর গাছে ফল আসে। একটি মঞ্জরিতে দু–চারটি লম্বা লম্বা ফল ধরে। পরিণত ফল পাকার পর লম্বালম্বিভাবে ফেটে যায়। ফলের ফাটা অংশ দেখতে অনেকটা নৌকার খোলের মতো। প্রতিটি ফলের ভেতরে প্রায় স্বচ্ছ ডানাযুক্ত ক্ষুদ্র হৃদয়াকৃতির বীজ থাকে। একটা ফলে পাঁচ শতাধিক বীজ হয়ে থাকে। বীজগুলো হালকা। এ কারণে বীজ অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। সেখান থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়।