চার আসামিকে নির্যাতনের অভিযোগ শরীয়তপুরের সেই ওসি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে
ছাত্রলীগ নেতার সহায়তায় ছিনতাই মামলার চার আসামিকে ধরে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। ওই ৪ আসামির পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে জানিয়ে সদর হাসপাতাল থেকে ৬ জুন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
এদিকে ওই ছিনতাইয়ের ঘটনার জের ধরেই এক ব্যবসায়ীকে থানায় আটকে রেখে পিটিয়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর ওসি মোস্তাফিজুর রহমানকে জেলা পুলিশ কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৭ জুন তাঁকে বদলি করা হয়। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি থানার ওসির দায়িত্ব পরিদর্শকের (তদন্ত) কাছে হস্তান্তর করেছেন।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা সূত্র ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে গত ২১ মে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মুঠোফোন ছিনতাই হয় বলে অভিযোগ। তাতে ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা খোয়া গেছে এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এতে বকুল চোকদার, মো. সাদ্দাম চোকদার, সাইদুল শেখ ও মো. আনোয়ার হোসেনসহ ৯ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
ভুক্তভোগী ওই চার আসামির ভাষ্য অনুযায়ী, গত ২৯ মে তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তাঁরা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তাঁদের ওপর চড়াও হন জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী ও ছিনতাই মামলার বাদীর আত্মীয় শহীদুল ইসলাম। পরে রুবেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে মুঠোফোনে কেরানীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানেই একটি কক্ষে আটকে তাঁদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
জানতে চাইলে জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাঁর ডলার এবং টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি তাঁর ভাগ্নে হন। তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য সামাজিকভাবে তিনি মামলার আসামিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ঢাকায় তাঁদের অনুসরণ করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তখন ধস্তাধস্তিতে তাঁরা ব্যথা পেতে পারেন।
শরীয়তপুর আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২৯ মে রাতে ওই চার যুবককে গ্রেপ্তার করা হলেও ১ জুন তাঁদের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেন পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি আসামিদের আদালতে উপস্থাপন করার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে নিলাফুলা জখম হয়েছেন। তাঁদের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ৪ জুন ওই চার আসামির জামিন ও রিমান্ড শুনানির দিন ছিল। ওই দিন আসামিপক্ষের আইনজীবী চারজনকে গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনের বিষয় আদালতের নজরে আনেন। আদালত তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে মেডিকেল প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন।
ওই অভিযোগ সঠিক নয়। অপরাধীরা হয়তো মামলা থেকে বাঁচার জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন।
সদর হাসপাতাল থেকে ৬ জুন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মেডিকেল প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সুমন কুমার পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ৪ জুন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল-ইমরান চারজন আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখেছেন, তাঁদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ আঘাতগুলো কীভাবে করা হয়েছে, তা বলতে পারবেন না।
ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার বলেন, ‘আমাদের চোখ বেঁধে আটকে রেখে দুই দিন ধরে পিটিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে হাড় ও হাত পায়ের গিরায় পেটানো হয়েছে। প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে দেওয়া হয়েছে। আমার বাম চোখে লাথি মেরেছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির।’
বকুল চোকদার বলেন, ‘আমাদের পিটিয়েছে আর জিজ্ঞেস করেছে “টাকা কোথায় রেখেছিস?” “তোদের ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে, তোরা টাকা নিয়েছিস, তা স্বীকার কর”। চোখ বেঁধে দুজন করে আলাদা করে ফেলেছিল। দুজনকে এনকাউন্টার দেওয়া হয়েছে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। আমার চাচাত ভাই সাদ্দামকে মেরে ফ্লোরে ফেলে রাখার পর সে পানি খেতে চেয়েছিল। তখন আমাকে ভাইয়ের মুখে প্রস্রাব করে দিতে বলে। আমি কান্না করি, আবার পেটায়। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের শরীরে প্রস্রাব করে দিই।’
নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরের কাছে আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা থেকে সদ্য বদলি হওয়া ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটি সন্ত্রাসবিরোধী ও ছিনতাই মামলার চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। ওই অভিযোগ সঠিক নয়। অপরাধীরা হয়তো মামলা থেকে বাঁচার জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের সময় নির্যাতন করেছে এমন কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে কেউ করেনি। বিষয়টি আদালতের নজরে এসেছে কিনা তা জানা নেই। তবে নাওডোবা এলাকার এক ব্যবসায়ীর একটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।