সমুদ্রসীমায় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ, খুশি জেলেরা
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ৬৫ দিনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করেছে সরকার। এতে সময়সীমা কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ করার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় একই সময়ে করা হয়েছে। গত রোববার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে মৎস্য গবেষক, জেলে ও ব্যবসায়ীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
দেশের মৎস্য গবেষক, জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিন্যাসের দাবি করে আসছিলেন। সেই সঙ্গে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তার ওপর কারিগরি গবেষণার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন।
ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের জলসীমায় মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিন্যাস করার বিষয়টিকে যুগান্তকারী বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের সাবেক গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী। আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এটা দেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাতের জন্য সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন দাবি করে আসছিলাম। কারণ, আগে সরকার যে উদ্দেশে এই নিষেধাজ্ঞা দিত, তা দুই দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় প্রতিবেশী দেশকে লাভবান করত। এটা আমাদের মৎস্যসম্পদের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, মাছের বংশবিস্তার, বেড়ে ওঠা ও টেকসই আহরণের জন্য বঙ্গোপসাগরে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। প্রতিবছর বাংলাদেশের জলসীমায় এই নিষেধাজ্ঞা থাকে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন। আর ভারতের জলসীমায় তা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন (৬১ দিন)। জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার মধ্যে প্রায় ৩৯ দিন ভারতীয় জেলেরা দেদার বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যান। এতে দেশের লাখ লাখ জেলেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। সেই সঙ্গে সরকার যে উদ্দেশে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করত, তা শুধু ব্যাহতই হয় না; বরং দেশের সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ উৎসে মাছের মজুতও হুমকিতে পড়ে।
সরকার মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তাতে প্রতিবছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা থাকবে বঙ্গোপসাগরের ভারতের জলসীমায়ও। এ ক্ষেত্রে ভারতের নিষেধাজ্ঞো বলবৎ থাকার দুদিন আগে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিক মৎস্য-২ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে গত রোববার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন।
মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে সব ধরনের নৌযানকে এর আওতায় আনা হয়। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে উপকূলের কয়েক লাখ জেলে দুর্বিষহ অবস্থার মুখোমুখি হন। নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করার জন্য বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশের উপকূলীয় এলাকার জেলেরা নৌ অবরোধ, মানববন্ধনসহ নানা আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের দাবি তুলে ধরে আসছিলেন। সেই সঙ্গে দেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদেরও বিষয়টি নিয়ে গবেষণার তাগিদ ছিল। কিন্তু এত দিন বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের ছয়টি মৎস্যজীবী সংগঠন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ২০১৮ সালের ৮ মে দুই দেশের জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল। বাংলাদেশের পক্ষে যে তিনটি সংগঠন ওই স্মারকে স্বাক্ষর করে এর মধ্যে চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন একটি। সংগঠনটির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশের জলসীমায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রায় ৩৯ দিন ভারতীয় জেলেরা মাছ এ দেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যেত। এখন সেই সুযোগ আর থাকবে না।
শাহ আলম মল্লিক বলেন, ‘আমরা বিষয়টি (নিষেধাজ্ঞার সময়) নিয়ে আমাদের মৎস্য বিভাগ এবং ভারতের মৎস্যজীবী সংগঠনের মধ্যে আলোচনা করেছিলাম। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা আমাদের দাবির প্রতি একমত হয়েছিলেন। কিন্তু গত ছয় বছরে অজ্ঞাত কারণে জেলেদের এই দাবি ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। এখন সরকার নতুন যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবে। দেশে মাছের মজুত ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।’
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসের অভয়ারণ্যের নিষেধাজ্ঞা এবং সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, সব মিলিয়ে বছরে ১৪৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় তাঁদের। এখন তা আট দিন কমে গেল।
বরগুনার তালতলী উপজেলার বঙ্গোপসাগর তীরের জয়ালভাঙা এলাকার আলম মিয়া ও দুলাল মিয়া কয়েক বছর ধরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নিজেদের দুর্দশার কথা প্রথম আলোতে তুলে ধরেন। দুলাল মিয়া বলেন, ‘পেটে পাথর বেঁধে আমরা মাছ ধরায় বিরত থাকি। আর আমাদের পাশের দেশের জেলেরা আমাদের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে না হয় জেলেদের লাভ, না বাড়ে মাছের উৎপাদন। আমরা কষ্ট করতে প্রস্তুত আছি, যদি তাতে দেশের ভালো হয়। কিন্তু এতে তো ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হচ্ছে না। দুই দেশে মাছ ধরা বন্ধের একই সময় চাই আমরা।’
জেলেদের এই দাবি অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পুনর্বিন্যাস করেছে, বিষয়টি জানানো হলে ওই জেলেরা জানান, দাবি পূরণের বিষয়টি তাঁরা এখনো শোনেননি। স্বস্তির প্রকাশ করে আলম মিয়া বলেন, ‘সরকার মোগো বাঁচাইছে। নাইলে সব মাছ ওরা (ভারতের জেলেরা) ধউর্যা নেওনে, মোগো সাগর, গাঙ মাছশূন্য অইয়্যা গ্যালহে।’
মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার দাবি করে আসছিলাম। কারণ, এতে সাগর-নদী মাছশূন্য হয়ে পড়েছিল। জেলেরা খুব কষ্টে আছেন। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও ধ্বংস হওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছিল। দীর্ঘদিন পর হলেও এই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা খুব খুশি।’