ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে ৩৭ যুবককে জিম্মি, স্বজনেরা উভয়সংকটে

চুয়াডাঙ্গায় ইতালির নাম করে ৩৭ জনকে লিবিয়ায় আটকে রেখে টাকা দাবির অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীর স্বজনেরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবেছবি: প্রথম আলো

দুই শিশুসন্তান নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার ছিল জুয়েল ও পলির। ইতালিপ্রবাসী দূর সম্পর্কের এক দেবর ও ভাশুরের উন্নতি দেখে ভাগ্যবদলের স্বপ্ন দেখেন পলি। স্বামীকে ইতালিতে পাঠাতে যোগাযোগ করেন দালালের সঙ্গে। আয় ও জমি বিক্রির ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন জুয়েল।

দালাল চক্র ইতালির কথা বলে জুয়েলকে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। এরপর ৯ মাস ধরে আটকে রেখে নির্যাতন করে দফায় দফায় বিপুল অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ নেয়। ঋণে জর্জরিত পরিবার জুয়েলকে দেশে ফেরত আনতে চেয়েও পারছে না। দালাল চক্রের দাবি, আরও ২২ লাখ টাকা দিলেই মুক্তি পাবেন জুয়েল। এ ক্ষেত্রে উভয়সংকটে পড়েছেন পলি খাতুন।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের এই জুয়েল রানাসহ ৩৭ জন বর্তমানে লিবিয়ায় চক্রের হাতে জিম্মি। তাঁদের বাড়ি উপজেলার বেলগাছি, খেজুরতলা ও চরযাদবপুর গ্রামে। ভুক্তভোগী এসব পরিবারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গৃহবধূ পলি খাতুন। এ সময় ভুক্তভোগী কয়েকজনের স্বজন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।

স্বজনেরা অভিযোগ করেন, উপজেলার বেলগাছি গ্রামের মো. জান্টুর ছেলে প্রবাসী মো. সাগর মানব পাচার চক্রের মূল হোতা। জান্টু ও তাঁর স্ত্রী আমেনা খাতুন, ছেলে জীবন আহমেদ, ভাই মো. ঠান্টু ও ঠান্টুর স্ত্রী বেলগাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বেদানা খাতুন ও ছেলে জীম স্থানীয় দালাল। সাগরের পক্ষে ওই সাতজন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

ভুক্তভোগী তুহিনের বাবা রেজাউল হক ওই সাতজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে আলমডাঙ্গা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। গতকাল বুধবার সেটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযুক্ত দালাল চক্রের সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং লিবিয়ায় জিম্মি স্বজনদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।

স্বজনেরা জানান, ইতালিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নেন। কিন্তু তাঁদের ইতালিতে না নিয়ে প্রথমে দুবাই ও পরে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করেন। এরপর তাঁদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। জিম্মি অবস্থায় খাবারের জন্য প্রতি সপ্তাহে জনপ্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়। জিম্মিদশা থেকে মুক্তির জন্য পরিবারপ্রতি ২২ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। টাকার জন্য ভিডিও কলে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। হাত-পায়ের নখ তুলে নেওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়। এ অবস্থায় তাঁরা উভয়সংকটে পড়েছেন।

খেজুরতলা গ্রামের কল্পনা খাতুন বলেন, তাঁর ছেলে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। দালাল সাগরের প্রলোভনে পড়ে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ে। ছেলের জোরাজুরিতে ১০ কাঠা জমি বিক্রি ও দুটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাঁকে পাঠান। এ ছাড়া খাওয়া খরচের জন্য গত ৯ মাসে অন্তত এক লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এখন পাওনাদারদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আলমডাঙ্গার চরযাদবপুর গ্রামের সাবিনা খাতুন বলেন, দালালের প্রলোভনে পড়ে জমি বন্ধক, গরু বিক্রি ও ঋণ করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ভাইকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি অ্যাকন চাইরদিকতি সমেস্যায় পড়িচি। অ্যাকদিকি ভাইর ওপর মাফিয়াদের অত্যাচার, আরেকদিকি পাওনাদারদের তাগাদা। এসব দেকে স্বামীও খেপে গিয়েচে। অ্যাকন আমার মরণ ছাড়া উপায় নেই।’

ঋণ নিয়ে জামাতাকে বিদেশে পাঠিয়ে বিপাকে পড়েছেন খেজুরতলা গ্রামের আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘দালাল বুলেছিল জামুই বিদেশে পৌঁছানোর পরপরই দেড় লাখ ট্যাকা করে বেতন পাবে। এ জন্যি আগুন-পানি সমিতির অ্যাক লাখে মাসে ১৫ হাজার টাকার চড়া সুদি ঋণ নিই। শোধ কত্তি না পারাই ট্যাকা বাড়েই চলেচে। কপালে যে কী আচে, বুজতি পাচ্চিনে।’

আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের মামলাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে আসামিদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। মামলার পর আসামিরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।