গুণীদের গ্রাম সেনহাটি
সেনহাটি গ্রামটি এখন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় পড়েছে। গত কয়েক দশকে পাটকলকেন্দ্রিক শ্রমিক–অধ্যুষিত এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই গ্রামের পথেঘাটে এখনো ঐতিহ্যের শিকড় রয়ে গেছে।
‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’, ‘চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে’, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’—এমন সব নীতি–কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার।
কবি যে গ্রামে জন্মেছিলেন নাম তার সেনহাটি। গ্রামটি ঘেঁষে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ভৈরব নদ। গাছগাছালির ছায়াময় মনোরম পরিবেশ আর পাখির কলতানে মুখর সুন্দর ছবির মতো গ্রাম। কবি কৃষ্ণচন্দ্রের মতো আরও অনেক গুণী মানুষের জন্মভূমি সেনহাটি। ঐশ্বর্যের পাশাপাশি সভ্যতা, শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতির অকৃত্রিম চর্চাকেন্দ্র ছিল এই গ্রাম। অনেক প্রখ্যাত মানুষ বেড়ে উঠেছেন এই গ্রামের আলো-হাওয়ায়।
সেনহাটি গ্রামের ছেলে হয়েছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এই গ্রামেরই ছেলের জাতীয়তাবোধের উদ্দীপনা নিয়ে লেখা নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’ আলোড়িত হয়েছে পুরো বাংলায়। এই গ্রামের মেয়ের গানে মুগ্ধ হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। ভূষিত হয়েছেন ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে। এই গ্রামের ছেলে পেয়েছেন রায় বাহাদুর উপাধি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে আসতেন গানের আসরে।
সেনহাটি গ্রামটি এখন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় পড়েছে। গত কয়েক দশকে পাটকলকেন্দ্রিক শ্রমিক–অধ্যুষিত এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই গ্রামের পথেঘাটে এখনো ঐতিহ্যের শিকড় রয়ে গেছে। ভৈরবপাড়ে রয়েছে শত বছরের পুরোনো ঘাট। কিছুদূর পরপর এখনো পুরোনো স্থাপনা বা এর ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ১৮৩৪ সালের ১০ জুন সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬১ সালে তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাব শতক’ প্রকাশিত হয়। কবি কৃষ্ণচন্দ্রের আরও বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ ছিল। কবিতা লেখার পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। মনোরঞ্জিকা, কবিতাকুসুমাবলী, ঢাকা প্রকাশ, বিজ্ঞাপনী প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করছেন কবি। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
অধ্যাপক মো. বজলুল করিম সম্পাদিত ইতিহাস ও ঐতিহ্যে খুলনার দৌলতপুর বইয়ে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার সম্পর্কে লেখা, ‘কর্মজীবনে বহু পথ পাড়ি দিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত, জীর্ণ, শীর্ণ হয়ে শেষ জীবনে কবি নিজগ্রাম সেনহাটিতেই কাটান। এই সময় তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে সময় কাটাতেন। খুব ভোরে ভৈরব নদে স্নান করতেন। …ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শেষ জীবনে অর্ধাহারে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেন।’
সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেনহাটি বাজারের অদূরে ভৈরব নদের তীরসংলগ্ন শিববাড়ী মন্দির চত্বর। একই চত্বরে কয়েকটি মন্দির আছে। চত্বরের এক কোনায় একটি কামিনীগাছ ছিল। গাছটির নিচে বসে কবি লিখতেন। কবির জীবনের একমাত্র যে ছবি পাওয়া যায়, তা সেই কামিনীগাছের নিচে বসেই তোলা। কামিনীগাছের পাশে কবির স্মৃতিস্তম্ভ করা হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে। স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে কবির লেখা কবিতার দুটি লাইন ‘ওহে মৃত্যু, তুমি মোরে কি দেখাও ভয়, ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।’
কবির মৃত্যুর সাত বছর পর তাঁর বাড়ির সামান্য দূরে ১৯১৪ সালে গড়ে তোলা হয় ‘কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট’। ওই সময়ের ‘প্রভাতী সংঘ’ নামের একটি যুব সংগঠনের উদ্যোগে এই ইনস্টিটিউট তৈরি হয়।
ড. নীলিমা ইব্রাহিম ‘স্মৃতি ও শহর খুলনা’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘… যূথিকা রায় খুলনার মেয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম সেনহাটিতে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বসেও যূথিকাকে গান শিখিয়ে গেছেন।’
কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, কবির বসতভিটা ও পুকুর শত বছর আগেই দখল হয়ে গেছে। সেনহাটিতে কবির স্মৃতিচিহ্ন বলতে এখন শুধু স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ইনস্টিটিউট আছে। এই প্রতিষ্ঠান দুটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।
সেনহাটির এই মাটিতে অনেক মনস্বী ও যশস্বী সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন। বিখ্যাত নাট্যকার ও সাংবাদিক শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ১৮৯২ সালে সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাপ্তাহিক হিতবাদী, বিজলী, আত্মশক্তি পত্রিকায় সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটক সিরাজদ্দৌলা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল কলকাতার নাট্যনিকেতন মঞ্চে। এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি নাটকটির রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। কিংবদন্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নাটকটি প্রচারিত হয়। দেশের দাবি, কামাল আতাতুর্ক, বাংলার প্রদীপ, ভারত বর্ষ, এই স্বাধীনতা, রক্ত কমল, ঝড়ের রাতে, স্বামী–স্ত্রীসহ অনেক নাটক রচনা করেছেন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
সেনহাটির মাটিতে বেড়ে উঠেছিলেন আরেক কিংবদন্তি নজরুলগীতি ও গজল শিল্পী যূথিকা রায়। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সভায় তাঁকে দিয়ে নজরুলের গান গাইয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রণব রায়ের কথায় ও কমল দাশগুপ্তর সুরে রেকর্ড করা হয় যূথিকা রায়ের গাওয়া সেই দুটি গান— ভৈরবীতে ‘আমি ভোরের যূথিকা’ আর ইমনকল্যাণে ‘সাঁঝের তারকা আমি’। প্রকাশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে ৬০ হাজার কপি বিক্রি হয় সেই রেকর্ড। বাংলা গানের একটি ধারা হিসেবে যে ‘আধুনিক’ বাংলা গানের জন্ম হয়েছিল এই দশকে, সে ব্যাপারে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল যূথিকা রায়ের গাওয়া গান দুটির। তিনি পরে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন।
ড. নীলিমা ইব্রাহিম ‘স্মৃতি ও শহর খুলনা’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘… যূথিকা রায় খুলনার মেয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম সেনহাটিতে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বসেও যূথিকাকে গান শিখিয়ে গেছেন।’
প্রফুল্লচন্দ্র সেন ১৮৯৭ সালে সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি রাজনৈতিক জীবন বেছে নেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন ১৮৯৭ সালে সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি রাজনৈতিক জীবন বেছে নেন। গান্ধীবাদী এই রাজনীতিবিদ ১৯৪৮ সালে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় অসামরিক সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। বিধান রায়ের মৃত্যুর পর ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সেনহাটির স্থানীয় লোকজনের অনেকেই প্রতিভাময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অদূরে একটা বাড়িকে প্রফুল্ল সেনের বাড়ি বলে মনে করেন। ওই বাড়িতে গিয়ে এখনো চুন-সুরকির তৈরি পুরোনো ভবনের কিছু অংশের দেখা পাওয়া গেল। তবে বাড়ির বাসিন্দারা জানান, তাঁরা দীর্ঘকাল ধরে সেখানে বসবাস করছেন তবে বাড়িটি আগে কার ছিল তা তাঁদের জানা নেই।
প্রখ্যাত বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতা রবীন সেনের জন্ম এই সেনহাটি গ্রামে। তিনি ভারতের লোকসভারও সদস্য ছিলেন।
সেনহাটির কবি হীরালাল সেনের বই ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং লেখককে কারাগারে পাঠায়। সরকারি ব্রজলাল কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শংকর কুমার মল্লিকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে হীরালাল সেন ‘হুঙ্কার’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। রাজদ্রোহের বিবেচনায় ওই বই বাজেয়াপ্ত করে হীরালালের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার। বইটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। এই সূত্রে ১৯০৮ সালে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সমন পেয়ে সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কবিকে শেষ পর্যন্ত খুলনা আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্য মোটেই সরকারের পক্ষে যায়নি। তারপরও ওই মামলায় হীরালালের সাজা হয়েছিল। কারামুক্তির পর ১৯১০ সালে হীরালালকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে নিয়োগ করেন রবি ঠাকুর।
কুমুদবন্ধু দাস ১৮৮৮ সালে সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁকে রায় বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
অসংখ্য মেধাবীর জন্মভূমি সেনহাটির আরেক সন্তান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কুমুদবন্ধু দাস। ১৮৮৮ সালে সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁকে রায় বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
ইতিহাস ও সাহিত্যের বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, সেনহাটি গ্রামে অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব রসিক লাল দাস, দ্বিজরাজ ভট্টাচার্য, রতিকান্ত দত্তের জন্ম এই গ্রামেই।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, ‘সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান’ থেকে জানা যায়, অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী অনুজাচরণ সেনের জন্ম সেনহাটিতে। কলকাতার অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট সাহেবকে মারতে গিয়ে তাঁর বোমাটি তাঁর কাছেই ফেটে যায় এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
একই বইয়ে উল্লেখ আছে, ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বিপ্লবী অতুল সেনের জন্ম সেনহাটিতে। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক আলফ্রেড ওয়াটসনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লবীরা। এই গুরুদায়িত্ব পালনের ভার যুগান্তর দলের নিষ্ঠাবান কর্মী অতুল সেনের ওপর। ওয়াটসনকে এককভাবে আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হন। ধরা পড়ার মুহূর্তে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মহাপণ্ডিত বিনোদরাম সেন কবি রত্নাকর, মাসিক শিশু পত্রিকা সখার প্রবর্ত্তক শিশুসাহিত্যিক প্রমদাচরণ সেন, ভূতপূর্ব হাইকোর্টের উকিল বঙ্কিমচন্দ্র সেন, রায় বাহাদুর বিপিনবিহারী সেন, রিপন কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ ত্রিগুণাচরণ সেন, ‘সদ্বৈদ্য-কুলপঞ্জিকা’র গ্রন্থাকার রামকান্ত কবিকণ্ঠাহার, প্রসিদ্ধ লেখক কালীপ্রসন্ন দাসগুপ্ত সেনহাটির কৃতী সন্তান।