ছাগল–কাণ্ড: মতিউরের গ্রামে গিয়ে যা জানা গেল
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরিঘাট দিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদ পার হয়ে ওপারে গেলে মুলাদী উপজেলা। সেখানে বাহাদুরপুর গ্রামের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন বললেন, ‘কোথায় যাবেন? পিন্টু সাহেবগো বাড়ি? ’ এই পিন্টু সাহেব হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান।
ফেরিঘাট থেকে মুলাদী উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই পথ ধরে যেতে মাঝে পেয়াদারহাট নামে একটি গ্রামীণ বাজার। সেখান থেকে পূর্ব দিকে খালের পাড় ধরে চার কিলোমিটার সরু পথ গেলে বাহাদুরপুর গ্রাম। এ গ্রামেই মো. মতিউর রহমানের বাড়ি।
বাহাদুরপুর গ্রামে মতিউরের বাড়ির সামনে খালের ওপরে পাকা সেতু। বাড়িতে ঢুকতে একপাশে তিনতলা হাফেজি মাদ্রাসা, আরেক পাশে দোতলা মসজিদ। মাঝখানে তোরণ। তোরণ পার হয়ে ভেতরে দোতলা বাড়ি। বাড়ির কলাপসিবল গেটে ঝুলছে তালা। বাড়ির সামনে কয়েকজনকে পাওয়া গেল।
তাদের একজনের নাম মো. ফকরুদ্দিন, অপরজন মাহমুদুন্নবী। দুজনই এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের চাচাতো ভাই। মাহমুদুন্নবী ঢাকায় ওষুধের ব্যবসা করেন। আর ফকরুদ্দিন এই বাড়ি ঘিরে গড়ে ওঠা মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ পরিচালনায় গঠিত হাওলাদার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক।
মতিউর রহমান সম্পর্কে কথা তুলতেই মাহমুদুন্নবী বললেন, ‘মানুষ মানুষের ভালো সহ্য করতে পারে না। ঈর্ষান্বিত হয়ে শত্রুতা করে। সে জন্যই আজ মতিউর রহমানের মতো একজন ভালো মানুষকে নিয়ে এত টানাহেঁচড়া চলছে।’ মতিউর সম্ভ্রান্ত ও ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান দাবি করে মাহমুদুন্নবী বলেন, মতিউরের দাদা হাজি আফাজ উদ্দীন হাওলাদার ব্রিটিশ আমলে জাহাজে করে হজ করতে গিয়েছিলেন। বাবা হাকিম হাওলাদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পরে কাজিরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
তবে এলাকার লোকজনের ভাষ্য, মতিউরের বাবা ও পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। যে জমিজমা ছিল তা দিয়ে খেয়ে-পরে মোটামুটি ছিল।
মতিউরের বাড়ির সামনে যে সরু খালটি আছে, সেটার দৈর্ঘ্য প্রায় চার কিলোমিটার। এই খালের দুই পাড় সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা। দুই পারের বাসিন্দারা যাতে এই খালের পানি দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য প্রতিটি বাড়ির সামনে সান বাঁধানো ঘাট করে দেওয়া হয়েছে। খালটিতে অন্তত আটটি পাকা সেতু, দুই পারে পাকা সড়ক নির্মাণ করায় পুরো গ্রামের মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে। বাড়ি থেকে একটু দক্ষিণ দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ। এর পাশেই তিনতলা একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্লিনিকের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে হাওলাদার ফাউন্ডেশন নামের একটি তহবিল। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনা হচ্ছে।
হাওলাদার ফাউন্ডেশনের এত বিপুল তহবিলের উৎস কী—এমন প্রশ্ন করা হলে ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ফকরুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মানুষের অনুদান থেকে তহবিল আসে।
এলাকার মানুষের অর্থে কি এত কিছু করা সম্ভব—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিরাও সহায়তা করেন।
মতিউরের স্বজনেরা বলেন, তিনি খুব একটা এলাকায় আসতেন না। তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ হাওলাদার বলেন, ২০১৮ সালে মতিউর রহমানের বাবা আবদুল হাকিম হাওলাদারের মৃত্যুর খবরে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। পরের বছর মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মাত্র ছয় ঘণ্টার জন্য বাড়িতে আসেন। বাড়িতে তাঁর ছোট ভাই নুরুল হুদা ও মেজ ভাই কাইয়ুম হাওলাদার মাঝেমধ্যে আসেন। নুরুল হুদা ঈদের এক দিন আগে এসে কোরবানি দিয়ে গত শুক্রবার ঢাকায় চলে গেছেন। মুলাদী পৌর এলাকার থানার পাশে মেজ ভাই কাইয়ুম হাওলাদারের দোতলা বাড়ি আছে, মাঝেমধ্যে তিনি (ভাই) সেখানে এসে থাকেন।
মতিউরের বাবা শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসরের পর ২০০৩ সালে কাজিরচর ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমানে মুলাদী উপজেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক ইউসুফ আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ছেলের অর্থবিত্তের জোরে বাবার এমন জয় বলে এলাকায় আলোচনা আছে।
এ প্রসঙ্গে কাজিরচরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, মতিউর রহমানের বাবা মুলাদী আসনের তৎকালীন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেনের (মঙ্গু) সমর্থন পেয়েছিলেন। তাঁর মেজ ছেলে কাইয়ুম হাওলাদার ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
তবে মতিউরের স্বজনেরা বলেছেন, হাকিম হাওলাদার বা এই পরিবার বিএনপির রাজনীতি করেনি। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ভালো মানুষ ছিলেন, তাঁর সঙ্গে মিলে উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তাঁরা।
ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাসের দাবি, যে জায়গায় নগমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ করা হয়েছে, খাল ভরাট করে সেটা করা হয়েছে। এতে এলাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ওই সময় এ নিয়ে এলাকার কৃষকেরা প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। এখন ওই বিদ্যালয়ের পাশে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়। একইভাবে খালের পাড় বাঁধাই, সেতু, রাস্তাঘাটও মতিউর রহমানের প্রভাবে নির্মিত হয়েছে।
বাহাদুরপুর গ্রাম থেকে ফেরার পথে খালের পূর্বপাড়ে ছোট্ট একটি বাজার দেখা যায়। সেখানে আছে কয়েকটি চায়ের দোকান। এসব দোকানে বসে চা পান করছিলেন স্থানীয় কয়েকজন। সেখানে আলাপচারিতার একপর্যায়ে মতিউরের বিষয়ে কথা তুললে দুজন ব্যক্তি আগ বাড়িয়ে বলেন, মতিউর সাহেব অনেক ভালো মানুষ। শুধু শুধু তাঁর নামে বদনাম করা হচ্ছে। আরেকজন বলেন, ‘সবার মাথার চুলই তো কালো!’