জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক অপকর্ম, প্রশাসন নির্বিকার
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাসে বারবার ঘটছে নানা অপকর্ম। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ, যত্রতত্র মাদক সেবনের মতো অপকর্মে জড়াচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে স্বামীকে হলে আটকে রেখে এক নারীকে ক্যাম্পাসে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। যাতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ছয় শিক্ষার্থীর সনদ স্থগিত করেছে প্রশাসন। এই ছয় শিক্ষার্থীর চারজনই ছাত্রলীগের নেতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন সময় অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রশ্রয় পাওয়ার অভিযোগ আছে। ফলে সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ক্রমেই অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সবাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলে নিজের কক্ষে গত বছরের ৪ জুন বহিরাগত বান্ধবীকে নিয়ে অবস্থান করায় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের কর্মী জয়দ্বীপ দাসকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করে প্রশাসন। নির্দেশনা ছিল, বহিষ্কার চলাকালে তিনি কোনো ক্লাস–পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এবং আবাসিক হলে অবস্থান করতে পারবেন না। এরপরও জয়দ্বীপ হলে অবস্থান করেন।
একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় গত ৭ জানুয়ারি রাতে খাবার খেতে গিয়েছিলেন শাখা ছাত্রলীগের উপছাত্রবৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আল রাজী সরকার। খাওয়া শেষে টাকা চাওয়ায় তিনি মারধর করেন বলে অভিযোগ দোকানির।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বাসে হেনস্তার অভিযোগে গত বছরের ১৪ অক্টোবর লাব্বাইক পরিবহনের সাতটি বাস আটক করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর দুই দিন আগে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে বাসে উঠতে না দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগে সেলফী পরিবহনের ২০টি বাস আটক করে সংগঠনটির নেতা–কর্মীরা। গত ৯ অক্টোবর হাফ ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থীর মাথায় আঘাত পাওয়ার অভিযোগে সাভার পরিবহনের ১৮টি বাস আটক করেন আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের এক দল শিক্ষার্থী। প্রতিটি ঘটনায় বাস মালিকপক্ষের কাছ থেকে জরিমানা হিসেবে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। বাসগুলোকে আটকে রাখা হয়েছিল ক্যাম্পাসে।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে হল–সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ।
গত বছরের ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা চাঁদার দাবিতে সাভার-আশুলিয়া রুটে চলাচলকারী ২৪টি লেগুনা আটকে রাখেন। গত বছরের ১ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পানধোয়া এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী মমিনউল্লাহর কাছে দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে লাইনম্যান খায়রুলকে ক্যাম্পাসে এনে মারধর, ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ইসলামনগর বাজারে এক জুতার দোকানদার ও তাঁর কর্মচারীকে মারধর, ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেনকে তুচ্ছ ঘটনায় মারধর, সায়েম হাসান নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে না যাওয়ায় পরে শহীদ সালাম-বরকত হলের গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে মারধর ও মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা এবং ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙামাটি এলাকার বাসিন্দা ফরিদ হোসেনকে বাসা থেকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় প্রশাসনিকভাবে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বেশ কয়েকটি ঘটনায় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলে নিজের কক্ষে গত বছরের ৪ জুন বহিরাগত বান্ধবীকে নিয়ে অবস্থান করায় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের কর্মী জয়দ্বীপ দাসকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করে প্রশাসন। নির্দেশনা ছিল, বহিষ্কার চলাকালে তিনি কোনো ক্লাস–পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এবং আবাসিক হলে অবস্থান করতে পারবেন না। এরপরও জয়দ্বীপ হলে অবস্থান করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন করছেন অনেকে। কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন সাভার-আশুলিয়া এলাকা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেই তাঁদের সখ্য রয়েছে।
নিপীড়ন থেকে ধর্ষণ, সবই ঘটছে
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীসহ বাইরে থেকে আসা নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীসহ নিরাপত্তাকর্মীরা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় ‘মানসম্মানের ভয়ে’ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দেন না বলে জানান তাঁরা।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে হল–সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। এ ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজুরসহ ছাত্রলীগের চারজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম এলাকায় ঘুরতে এসে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী সহযোগী অধ্যাপককে হেনস্তা করে টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
বর্তমান প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাম্পাসে অবাধে মাদক সেবন চলছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনেই মাদক নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে মদ আনতে গিয়ে সেই অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় প্রাণ যায় দুজনের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে নির্বিকার।ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের (একাংশ) আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ
সন্ধ্যা হলেই মাদকের ছড়াছড়ি
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, স্কুল ও কলেজ মাঠ, মনপুরা এবং শান্তিনিকেতন এলাকায় মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদকের এ আড্ডায় যোগ দেওয়া অধিকাংশই থাকেন বহিরাগত। সম্প্রতি এসব এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন করছেন অনেকে। কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন সাভার-আশুলিয়া এলাকা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেই তাঁদের সখ্য রয়েছে।
ক্যাম্পাসের একাধিক নিরাপত্তারক্ষী বলেন, মাদকসেবীদের বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পরিচিত। বহিরাগত ব্যক্তিদের কিছু বলতে গেলে, ওই সব শিক্ষার্থী কখনো মুঠোফোনে আবার কখনো উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের বাধা দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহিরাগত মাদকসেবীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের (একাংশ) আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেন, বর্তমান প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাম্পাসে অবাধে মাদক সেবন চলছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনেই মাদক নিয়ে আসা হয়। কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে মদ আনতে গিয়ে সেই অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় প্রাণ যায় দুজনের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে নির্বিকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অপরাধে জড়ান। প্রশাসন তাঁদের যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসে না। এসব একদিকে যেমন প্রশাসনের বিচারহীনতা, অন্যদিকে প্রশাসনের অদক্ষতা, অযোগ্যতাকে প্রমাণ করে। যার কারণে এই অপরাধগুলো আরও বেড়ে চলেছে।দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে বলে মনে করেন প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত এবং অভিযোগ পেলে তাঁরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ না পাওয়ায় বিচার করাও হয় না।
অপরাধীদের কোনো ছাড় নেই উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধে আমরা বহিষ্কার করার পরেও যারা হলে থাকে, তাদের কোনো এখতিয়ার নেই হলে থাকার। কোন কোন হলে বহিষ্কৃতরা থাকে, খোঁজ নিয়ে এখনই তাদের বের করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি অপরাধীদের বিচার করত, তাহলে এই অপরাধগুলো বাড়ত না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অপরাধে জড়ান। প্রশাসন তাঁদের যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসে না। এসব একদিকে যেমন প্রশাসনের বিচারহীনতা, অন্যদিকে প্রশাসনের অদক্ষতা, অযোগ্যতাকে প্রমাণ করে। যার কারণে এই অপরাধগুলো আরও বেড়ে চলেছে।