ভাতাভোগী ব্যক্তিদের টাকা তুলে নিচ্ছে ডিজিটাল প্রতারকেরা
‘সমাজসেবা অফিস থেকে বলছি, অন্তর্বর্তী সরকার আপনার ভাতার তথ্য যাচাই–বাছাই করছে। আপনি ভাতা নিতে চাইলে কিছু তথ্য দিন। আপনার মোবাইলে একটি কোড যাবে, তা জানালে ভাতা ঠিক থাকবে।’ এভাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভাতার টাকা তুলে নিচ্ছে ডিজিটাল প্রতারকেরা। গত কয়েক দিনে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার অন্তত ১ হাজার ৩৫০ ভাতাভোগী প্রতারকের ফাঁদে পড়ে ২০ লক্ষাধিক টাকা খুইয়েছেন।
চার দিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ও প্রতারিত ভাতাভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের কাছ থেকে কল দেওয়া মুঠোফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে সব কটি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া যে মুঠোফোন নম্বরের মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও বন্ধ পাওয়া গেছে।
উপজেলায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় মোট ৩১ হাজার ৩২৪ জন ভাতা পেয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, অনগ্রসর বিশেষ গোষ্ঠী, শিক্ষা প্রতিবন্ধী ও সমতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ভাতা রয়েছে। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এসব ভাতা দেওয়া হলেও রাজশাহী এলাকার সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের মাধ্যমে টাকা পেয়ে থাকেন। মুঠোফোনে ভাতার টাকা চলে আসে।
উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে ও ভাতাভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন মাস পরপর ভাতাভোগী ব্যক্তিদের মুঠোফোনে নগদ অ্যাকাউন্টে ভাতার টাকা আসে। পরে ভাতাভোগী ব্যক্তিরা সুবিধামতো সময়ে ভাতার টাকা তুলে নেন। চলতি মাসের শুরুতে ভাতাভোগী ব্যক্তিদের নগদ নম্বরে ভাতার টাকা আসতে শুরু করে। এই সুযোগে একটি প্রতারক চক্র সমাজের দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ভাতার টাকা তুলে নিচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৩৫০ জন প্রতারকের ফাঁদে পড়ে টাকা হারিয়েছেন।
সূত্রটি জানায়, বয়স্ক ভাতার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা তিন মাস অন্তর অন্তর ১ হাজার ৮০০ টাকা, বিধবারা ১ হাজার ৬৫০ টাকা, প্রতিবন্ধীরা ২ হাজার ৫০০ টাকা, অনগ্রসর বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্য ১ হাজার ৫০০ টাকা করে ভাতার টাকা পেয়েছেন মুঠোফোনে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষা ভাতা দেওয়া হয় স্কুল ও কলেজে আলাদা পরিমাণে। ভাতার টাকা মুঠোফোনে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকেরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা নতুন সরকারের হয়ে তথ্য যাচাইয়ের কথা বলে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের কাছ থেকে গোপন নম্বর নিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছে।
ঝিকড়ার রায় সেনপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী মকছেদ আলীর স্ত্রী আসমা খাতুন (৪৮) বলেন, তাঁর মোবাইলে আড়াই হাজার টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রতারক নিজেকে সমাজসেবা অফিসের লোক পরিচয় দিয়ে তথ্য যাচাইয়ের নামে গোপন নম্বর নিয়ে সব টাকা তুলে নিয়েছেন। পরে স্থানীয় এক দোকানে টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পেরেছেন, কোনো টাকা নেই। গত বৃহস্পতিবার উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে নিজের প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। এ সময় তিনি হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, এই টাকা দিয়ে অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কেনা হয়।
মোহনগঞ্জ গ্রামের বিধবা গোলনাহার বেগম জানান, এই ভাতার টাকা দিয়ে ও হাঁস-মুরগি পালন করে কোনো রকম সংসার চলে। মোবাইলে তথ্য নিয়ে প্রতারকেরা টাকাগুলো সব তুলে নিয়েছে।
ওই এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ নাসের আলী (৭৮) বলেন, স্থানীয় এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগের পর তাঁকে সতর্ক করে দেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল নম্বরটা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ (২৬) বলেন, তাঁর ছোট ভাই একজন প্রতিবন্ধী স্কুলছাত্র ও ভাতাভোগী। ভাতার টাকা আসার পর একটি মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন করে তাঁর মায়ের কাছ থেকে গোপন নম্বর নিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে প্রতারকেরা।
প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, সরকারি লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরটা কীভাবে প্রতারক চক্রের হাতে গেল?
তবে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ভাতাভোগী ব্যক্তিদের সব তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে। এ ছাড়া যে কোম্পানি টাকা পাঠায়, তাদের কাছেও আছে মোবাইল নম্বর। তাঁদের দপ্তর থেকে মোবাইল নম্বর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁরা জানান, যাঁরা অফিসে এসে অভিযোগ করছেন, তাঁদের সজাগ করে দেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। ওই নম্বরে নতুন করে নগদের হিসাব চালু করার জন্য বলা হচ্ছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার সরকার পরিবর্তনের কথা বলে বিশ্বাস স্থাপন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। তাঁর দপ্তর থেকে প্রতারক চক্রের বিষয়ে সজাগ করে এলাকায় মাইকিং ও মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ বিষয়টি জানিয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।